‘সিনেপাট’–এর দৃশ্যে সোহেল শেখ
‘সিনেপাট’–এর দৃশ্যে সোহেল শেখ

‘সিনপাট’–এ আমার অভিনেতা একজন ‘ডাকাত’

চরকির অরজিনাল ওয়েব সিরিজ ‘সিনপাট’-এ মূল চরিত্রে অভিনয় করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সোহেল শেখ। একাধিক মামলার আসামি এই মানুষের সিনেমা জগতের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্কই ছিল না। কীভাবে তাঁকে খুঁজে পেলেন, সেই গল্প বলেছেন নির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম

শাটিকাপ–এর পর নতুন গল্প খুঁজছিলাম। ইউনিটের একজন একদিন গল্পে গল্পে তাঁর এক আত্মীয়ের কথা বললেন। মানুষটার নাম সোহেল শেখ। বয়স প্রায় ৪০। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, এমনকি খুনের মামলার আসামিও হয়েছেন, কখনো নেতার ক্যাডার হিসেবে কাজ করেছেন।

সোহেল শেখের খোঁজে একদিন পাবনার নগরবাড়ী যাই। সেখানে শোনা স্থানীয় শব্দ ‘সিনপাট’(সিন ক্রিয়েট) মনে ধরে যায়। শেষ পর্যন্ত চরকিতে আমার সিরিজের নামই হয়ে যায় সিনপাট। আর সোহেল শেখকে পেয়ে সিরিজের গল্পটাও পেয়ে যাই।

প্রথম দিনই চাকু নিয়ে সঞ্জয় দত্তের একটি ডায়ালগ দেন সোহেল। এই সংলাপের একটি ভিডিও ফুটেজ আগেই একজনের মোবাইলে আমি দেখেছিলাম। ওইভাবেই ডায়ালগটা দিলেন সোহেল। খেয়াল করলাম, মানুষটার ভেতরে যথেষ্ট রসবোধও আছে। পরে তাঁর জীবনের গল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ নিয়ে সিরিজ সাজাই। তাঁকে দিয়েই অভিনয় করাই। কিন্তু মুশকিল হলো তিনি পড়তে পারেন না। মুখস্থও রাখতে পারেন না। এমনও হয়েছে তাঁর একটা সংলাপের শট নিতেই রাত ভোর হয়ে গেছে। আরেকটা সমস্যা ছিল তাঁর সঙ্গে সারাক্ষণ দুজন লোক লাগিয়ে রাখতে হতো। তিনি এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারেন না। একটা শট দিয়েই নেই। খোঁজ, খোঁজ...প্রায় এ রকম হতো। এ জন্য লোক লাগিয়ে রাখতে হতো। আর ছাড়া পেলেই টাকার সন্ধানে নেমে পড়তেন। তাঁর খালি টাকা চাই। টাকা পেলে আপেল, কমলা-ভালো ভালো জিনিস কিনে খাবেন। এক লাখ টাকা নিয়ে বের হয়ে তিন দিনেই শেষ।

সিনেমা জগতের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্কই ছিল না সোহেল শেখের

মানুষটার জীবনে দুঃখও আছে। হাজতে থাকতেই মা, বাবা ও প্রেমিকার মৃত্যু হয়েছে। জেলখানায় থাকতে একবার মাকে খবর দিয়েছেন, ‘তিন দিন পর এক হাজার টাকা পাঠিয়ো, ভেতরে একজনকে দিতে হবে।’ সেই তিন দিন পরেই মায়ের মৃত্যুর খবর পান। এগুলো তিনি ভুলতে পারেন না।

ছোটবেলা থেকেই তাঁর চুরির স্বভাব। এর-ওর গাছের আম-কাঁঠাল, এটা-সেটা চুরি করতেন। একটু বয়স হতেই একটি খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়েন। সেটি ছিল বন্ধুর প্রেমিকা খুনের মামলা। পরে আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সোহেল জড়িত ছিলেন না। বন্ধুর দিক থেকে তাঁকে মামলায় জড়ানো হয়েছিল। এখনো তাঁর নামে ছয়টি মামলা আছে। এগুলোয় জামিন করানো হয়েছে।

সব মামলার হিসাব তিনি নিজেও রাখেন না। হাজত থেকে ছাড়া পেলেন তো সেই মামলার হাজিরা দেওয়ার কথা ভুলে গেলেন। পরে আবার ওয়ারেন্ট হয়। তখন পুলিশ আবার ধরে নিয়ে যায়। তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। এমনও হয়েছে জেলখানার ভেতরে কোনো আসামির সঙ্গে কী মামলায় সে এসেছে, তা নিয়ে গল্প হচ্ছে, শুনতে শুনতে সোহেলের মনে পড়ে যায়, সেও ওই মামলার আসামি। বারবার তাঁকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তিনি নিজে কখনো হাজিরা দিতে আদালতে যান না।

সিনেপাটের পোস্টার

সিরিজে কাজ করার ব্যাপারে রাজি হওয়ার পর তাঁর মামলার জামিনের ব্যবস্থা করতে আমরা তাঁকে নিয়ে নির্ধারিত উকিলের কাছে যাই। উকিল শুনে বলেন, ‘কোন সোহেল? সোহেল শেখ? আরে তাঁর মতো মহৎ মানুষ হয় না! তিনি তো কোনো দিন পায়ে হেঁটে আদালতে আসেন না। পুলিশ তাঁকে গাড়িতে করে নিয়ে আসেন।’ উকিল বলেন, ‘তার কোনো মামলা আমি আর নিব না। আপনি কে হন।’

আমাদের লোক বলেছে, তিনি সোহেলের ভাই। তখন উকিল বলেছেন, সোহেলের ভাই-বোন কে কোথায় থাকেন, সব তিনি জানেন। আতাইকুলায় কোন বোন থাকেন, তা–ও তিনি জানেন। ‘ওসব বলে কাজ হবে না। আমি সোহেলের কোনো কেস নিব না।’

কেন নেবেন না, বারবার জানার জন্য অনুরোধ করা হলে উকিল বলেন, ‘আমরা একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সোহেল ভেতরে থাকলেই ভালো। বাইরে বের হলেই পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে আসবে। মামলা দেবে। তার চেয়ে ভেতরে থাকাই ভালো। এরই মধ্যে হয়েছে কী জেলে জজ গিয়েছেন, কারও কোনো সমস্যা আছে কি না বন্দীদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন। ওদের তো আগে থেকে শিখিয়ে রাখা হয়, কেউ কোনো সমস্যার কথা বলে না। কিন্তু সোহেল হাত তুলেছেন। কী সমস্যা জজ জানতে চেয়েছেন। সোহেল বলেছেন, আমার উকিল আর ভাইবোন মিলে আমার সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য আমাকে জেলখানার ভরে রেখেছেন। তাঁরা আমার জামিন করান না। উকিল সাহেব বলেন, জজ বের হয়ে এসেই আমার সেরেস্তায় পিয়ন পাঠিয়ে দিলেন। আমি তখন ভাত খাচ্ছিলাম। ভাত হাতে করেই ছুটলাম। গিয়ে শুনি এই অভিযোগ। বাধ্য হয়ে আমি তাঁর মামলা ছেড়ে দিই। জজ সাহেব সরকারি উকিল দিয়ে তাঁর জামিন করান।’

নির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম

সোহেলরা এক এলাকা থেকে আরেক এলাকার অপরাধজগতে ঢুকে যায়। জেলে অন্য এলাকার অপরাধীদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর কাছে হয়তো একটা কাজের খবর থাকে। হয়তো তিনি বরিশালের লোক। পরিচয়ের দরকার নেই। জেল থেকে বের হয়ে তাঁর সঙ্গেই কাজে চলে যান। যেমন সিনপাটে দেখানো হয়েছে নগরবাড়ী থেকে কীভাবে তিনি রাজশাহীর তালা খোলার ওস্তাদ ফাজুর সঙ্গে ডাকাতি ও মাদকের ব্যবসায়ে জড়িয়ে পড়েন।

ঝুঁকিপূর্ণ কোনো দৃশ্যে অভিনয়ের ব্যাপারেও তাঁর কোনো ভয়ডর নেই। সেই রকম একটা দৃশ্য ছিল ফেরির ওপর থেকে চেইন ছিনতাই করে নদীতে ঝাঁপ দেওয়া। ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ এই দৃশ্যে অভিনয় করার জন্যও তিনি একটু দ্বিধা করেননি। দৃশ্যটা এত বাস্তবানুগ হয়েছিল যে ফেরির লোকজনের হাতে আমাদের ইউনিটের দুজনকে মার খেতে হয়েছিল।

এক নেতার ক্যাডার হিসেবেও একবার কাজ করেছেন সোহেল। ওই এলাকায় একটা বিয়েবাড়ির খবর আসে তাঁর কাছে। সোহেল আর স্থির থাকতে পারেননি। অস্ত্র নিয়ে গিয়ে সোনার হার লুট করে আনেন। পরে ওই নেতার কাছে খবর আসে। তিনি সোহেলকে ধরেন, ‘এই তুই কী করেছিস।’ সোহেল সব স্বীকার করেন। ওই নেতার পতন হলে সোহেল এলাকা ছাড়েন।

এই মানুষকে অভিনয়ে নিয়ে আসা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি অভিনয় করেছেন। কিন্তু যেদিন ছবির প্রিমিয়ার হবে, সেদিন আর তার দেখা নেই। কোথাও নেই। মুঠোফোন কিনে দিলেও সঙ্গে রাখেন না। আরেকজন লোক দিয়ে তাঁকে খুঁজতে হয়। শেষ পর্যন্ত খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি হাজতে।

অনুলিখন: আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ