হাঁড়িতে হাঁড়িতে ঠোকাঠুকি হয়, একসঙ্গে দুজন চলতে গেলেও তা–ই। ঝগড়া হবে, চলবে মান-অভিমান। তবে সেসব অভিমান মনের মধ্যে পুষে রাখলে দাম্পত্যের খুঁটি নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই খুঁটির জোর বাড়াতে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে যেকোনো রাগ–অভিমান দ্রুত মিটিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
কেন এমন হয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দেশে দুজন মানুষ যখন নতুন জীবন শুরু করে, তখন অধিকাংশেরই দাম্পত্য নিয়ে যথাযথ ধারণা থাকে না। কেউ ঠিকঠাক পরামর্শ পাননা। শুধু একজন আরেকজনের প্রতি একধরনের প্রত্যাশা নিয়ে জীবন শুরু করেন। আর সেই প্রত্যাশা যখন পূরণ হয় না, তখন দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুজনের মধ্যে।’
অনেকে নিজের পছন্দে বিয়ে করেন। কেউ পারিবারিকভাবে দেখাসাক্ষাতের মাধ্যমে বিয়ের পর নতুন জীবন শুরু করেন। দুই ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রীর একজন আরেকজনকে গুরুত্ব দিতে হবে। ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে দুজনেরই। পরিবারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, অর্থনৈতিকভাবে কে কতটা অবদান রাখছেন। পরিবারের মধ্যে যে যতটা অর্থনৈতিক ভার বহন করেন, সচেতনভাবে হোক কিংবা অবচেতন মনে, তিনি অন্যজনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেন, যা একেবারেই হওয়া উচিত নয়।
এ তো গেল বড় পরিসরের ভাবনা। তবে রোজকার জীবনযাপনের সময়ও আমরা নানা ধরনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাই। হয়তো পুরুষ সঙ্গীকে তাঁর স্ত্রী দুই দিন ধরে একটি কথা কয়েকবার বলার পরও তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কথাটি শুনলেন না। তিনি মনে করলেন, এটা খুবই সাধারণ কোনো ঘটনা। কিন্তু আপনার স্ত্রী হয়তো এই বিষয় আপনার নজরে এনেছিলেন আপনার কাছ থেকে কোনো মতামতের প্রত্যাশায়। কিন্তু সেটাতে আপনার গুরুত্ব না পেয়ে, তাঁর মনের মধ্যে একধরনের অভিমান জমতে পারে। এই ছোট ছোট্ট অভিমান জমে কিন্তু একসময় বড় পাহাড় হয়ে উঠতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান মনের বন্ধুর সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলর নাদিয়া নাসরিন বলেন, ‘সঙ্গীকে উপেক্ষা করার মনোভাব তাঁর মনোবেদনা বাড়ায়। তাই সঙ্গীকে গুরুত্ব দিতে হবে, হোক সেটা খুবই ছোট কোনো বিষয়। আর দাম্পত্যে কথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোনো বিষয় নিয়ে রাগ করে দুজন কথা বন্ধ করে দিলে সেটা স্বাস্থ৵কর সম্পকে৴ বাধা তৈরি করে।’
কীভাবে গলবে বরফ
যখন দুজনের জায়গা থেকে দুজনই ঠিক বলে মনে করে ঝগড়া চালিয়ে যাবেন, তখন পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। তাই একজনকে তাৎক্ষণিক থেমে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিষয়টি বিশদে আলোচনা করলে ফল ভালো হবে। কাউন্সেলর নাদিয়া নাসরিনও তাই মনে করেন, দুজনই যখন একই সঙ্গে যুক্তি দিতে থাকবেন, কেউ হারতে চাইবেন না। তাই পরে আলোচনা করতে পারেন। দাম্পত্যে আরেকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো প্রশংসা করা। একজন আরেকজনের প্রশংসা করার সংস্কৃতি তৈরি হলে সম্পর্ক মজবুত হবে। কোনো অবস্থাতেই অভিযোগ না করে সমাধানের পথে থাকতে হবে।
যে কারণে পরামর্শকেরা বেলন, যখন একজন আরেকজনকে নিয়ে কথা বলবেন, তখন ‘তুমি এটা করেছ’ ধরনের কথা বলা ঠিক নয়। তার পরিবর্তে বলতে হবে ‘আমি’ দিয়ে। মানে নিজের খারাপ লাগার বিষয়গুলো উপস্থাপন করুন। এতে সমাধান সহজ হবে।
সমাজবিজ্ঞানী মুহাম্মদ মিজানউদ্দিনের পরামর্শও সেটাই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ালে ঝগড়া এড়িয়ে চলা যায়। অনেক সময় একটি সম্পর্কে থেকে অনেকে লুকিয়ে নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সেটা অনৈতিক। দুজনের প্রতি দুজনের অঙ্গীকার (কমিটমেন্ট) ঠিক রাখতে হবে। দাম্পত্যে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি সবই আসবে। তবে সেখান থেকে দুজনের চেষ্টায় ছায়াঘেরা পথে এগোতে হবে বলে মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী।
দুজনের মধ্যে অভিমান হলে অনেক সময় কথা বন্ধ করে দেন তাঁরা। এটা খুবই ভুল সিদ্ধান্ত। আলোচনা চলমান থাকলে অভিমান বাসা বাঁধতে পারে না। আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করলেন সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলর নাদিয়া, অনেক সময় ঝগড়ার পর আমরা বুঝতে পারি, সেটা ভুল হয়েছে। অহেতুক সন্দেহ করছেন একজন আরেকজনকে। কিন্তু ইগোর সমস্যা থেকে বেরিয়ে এসে সরি বলতে সমস্যা হয়। প্রিয়জনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলে ছোট হয়ে যায় না কেউ। এতে সম্পর্ক পোক্ত হয়। একান্তই মুখে বলতে না পারলে বিকল্প উপায়ে নাটকীয়ভাবে অভিমান কমানো যেতে পারে।
সন্ধ্যায় ঝগড়ার পর যখন দুজন দুদিকে মুখ করে রাত পার হলো, একজন হয়তো ভোরেই ঘুম থেকে উঠলেন। সঙ্গীর প্রিয় গানটাই আলতো করে ছেড়ে দিলেন ল্যাপটপ বা ফোনে। ঘুম ভেঙে তিনি কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারবেন আপনার মতলব।
কোনো দিন চুলার ধার না মাড়ানো আপনিই এক বেলা নাহয় চুলা জ্বালালেন। সঙ্গীর পছন্দের এক কাপ কফি নিজ হাতে বানিয়ে এনে তাঁকে দিন। কোনো কথা না বলেও অনেক কথা বলা হয়ে যাবে।
মুখে যে ‘সরি’ বলতে পারছেন না। সেটা লিখে মুড়িয়ে দিন চকলেটের মোড়কের ওপর। এসবেও কাজ হয়, ফিরে আসা যায় সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আমাদের মধ্যে অনেক সময় সামর্থ্যের চেয়ে বেশি চাহিদার জন্ম নেয়। যেটা দাম্পত্যে অশান্তি বাড়ায়। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন সেসব মাধ্যম।
প্রতিদিনের সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখুন ভালোবাসা দিয়ে। একটা ছোট্ট গাছ যেমন পানি, আলো-বাতাস দিয়ে বড় করে তুলতে হয়, ঠিক সেভাবে। দুজন মিলে গল্প করে, রান্না করে, এমনকি একসঙ্গে বাজারে গেলেও নিজেদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।
অপেক্ষাকৃত তরুণ দাম্পত্যে ঝগড়া-অভিমান বেশি থাকে। তাই এই সময়টা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়াতে হবে। একজন আরেকজনকে সময় দিতে হবে।
দুজনের মধ্যে অভিমান–ভালোবাসা না থাকলে সেই দাম্পত্যও একধরনের ম্যাড়মেড়ে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে পারে। তবে ঝগড়া করে দিনের পর দিন সেটা মনের মধ্যে চেম্বার খুলে জমিয়ে রাখলে দাম্পত্য সম্পর্ক ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। তাই ঝগড়া হোক, অভিমান জমুক, দুজন দুজনের সঙ্গে কথা বলুন। সমাধান নিজেই জায়গা করে নেবে।