হাতে হাতে স্মার্টফোন। প্রায় সব বাড়িতেই শিশুরা বুঁদ ডিজিটাল পর্দায়। শিশুর অবসর মানেই যেন মুঠোফোন ধরিয়ে দেওয়া। অনেক শিশুর খাওয়ার অভ্যাসও গড়ে ওঠে রিলস বা ভিডিও দেখতে দেখতে। তাই কোনো বেলার খাবার গ্যাজেট ছাড়া দিলেই শিশু তা মুখে তোলে না। এমনকি শিশুকে শান্ত রাখতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুঠোফোনে ইন্টারনেট সচল করে বসিয়ে দেন অভিভাবকেরা। দেশে হঠাৎ ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে যেসব মা-বাবা সন্তানকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো বা অবসর কাটাতে গ্যাজেট ও ইন্টারনেটকেই একমাত্র উপায় মনে করতেন, তাঁরাও বিকল্প খুঁজছেন। শিশুবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিকল্প পথটাই শিশুর জন্য জরুরি। মানে শিশুর গ্যাজেট বা ইন্টারনেটে আসক্তি কমাতে তাকে স্বাভাবিক বাস্তব জীবনে অভ্যস্ত করাতে হবে।
গ্যাজেট ও ইন্টারনেটে আসক্তির ভয়াবহ প্রভাব পড়ে শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায়। অনেক সময় মা-বাবা হয়তো নিজেদের সাময়িক সুবিধার জন্য শিশুর হাতে মুঠোফোন দিচ্ছেন, কিন্তু এতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় পড়ে শিশু। রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের জ্যেষ্ঠ মেডিকেল অফিসার ফাহমিদা রহমান বলেন, ‘শিশু বিভাগে কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেক অভিভাবকই শিশুকে নিয়ে আসেন মুঠোফোন ছাড়া খেতে চায় না বলে। অথচ ওই শিশু খাবারই চেনে না। মা-বাবা হয়তো তাকে খাওয়াতেন মুঠোফোন দেখাতে দেখাতে। ফলে শিশু কী খাচ্ছে, কেন খাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারত না। এটা অনেক শিশুর দেরিতে কথা বলার সমস্যাও সৃষ্টি করে।’
একই সঙ্গে শিশুর গ্যাজেট ও ইন্টারনেট আসক্তির কারণে আরও বেশ কিছু অসুবিধার কথা জানালেন এই চিকিৎসক—
সাধারণত প্রথম তিন বছর শিশুর মস্তিষ্কের বড় অংশের গঠন হয়। তাই এ সময় শিশু কী শিখছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুকে খাওয়ানোর সময় মুঠোফোন ধরিয়ে দিলে কোনটা কী খাবার, কোনটার স্বাদ কেমন, এসব শেখার সুযোগ পায় না।
কম দূরত্ব থেকে মুঠোফোন দেখার কারণে ডিজিটাল পর্দার বিভিন্ন ক্ষতিকর রশ্মি শিশুর চোখের ক্ষতি করে।
শিশু সামাজিকতা শেখে না। কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, এসব শেখায় ঘাটতি থাকে।
শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। অল্পতেই রেগে যায়। নিজের রাগ প্রকাশ করতে গিয়ে জিনিসপত্র ভাঙচুর, চিৎকার ইত্যাদি বাড়িয়ে দেয়।
একটানা মুঠোফোনে ভিডিও দেখার কারণে শিশুর রাগ বেড়ে যায়। মনোযোগের অভাব দেখা দেয়।
‘মুঠোফোন না দিলে সন্তান খেতে চায় না’ বলা অভিভাবকেরাও এরই মধ্যে দেশে ইন্টারনেট না থাকায় বিকল্প উপায়ে শিশুকে খাওয়াচ্ছেন বা সময় কাটাচ্ছেন। এ অভ্যাসই স্বাভাবিক ও সুবিধাজনক বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও সহযোগী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ। তিনি বলেন, ‘শিশুকে দ্রুত খাওয়ানোর জন্যই সাধারণত মা-বাবা ফোনে ভিডিও ছেড়ে দেন। ইন্টারনেট হয়তো কদিন পর ফিরে আসবে, শিশুরাও বায়না ধরবে মুঠোফোনের জন্য; তখন শিশুকে একবারে “না” করে দেওয়ার চেয়ে আগে বোঝাতে হবে খাবারটা শেষ করো, তারপর ফোন পাবে। এভাবেও কিন্তু শিশুকে দ্রুত খাওয়ানো যায়। তবে খাওয়ার পর শিশুকে ফোন দিলেও সেটার সময়সীমা বেঁধে দিন।’
খাওয়ানোর সময় শিশু যখন একটা খাবারের রং, স্বাদ, গন্ধ, আকার দেখবে, তখন খাবার নিয়ে নিজের মতামতও দিতে শুরু করবে।
শিশুকে খাওয়ানোর সময় গ্যাজেটের বদলে খাবারটা তৈরির গল্প বলতে পারেন। অনেক সময় খাবার ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে বলতে পারেন, ‘এসব পাখির ডিম’। তারপর একটা করে ‘ডিম’ তুলে দিতে পারেন শিশুর মুখে।
সময় কাটানোর জন্য শিশুকে গ্যাজেট নয়, বরং নানা ধরনের আকর্ষণীয় পাজল কিনে দিতে পারেন। বুদ্ধি খাটিয়ে সেসব মেলাতে মেলাতে শিশুর সময় কেটে যাবে।
শিশুর সঙ্গে গল্প করুন। তাকে নতুন নতুন বই পড়ে শোনাতে পারেন।