‘কাঁদবি না,’ তোমার এই কথা বোধ হয় রাখতে পারব না

প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।

শৈশবে মা–বাবার সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

২০০৯ সালের এপ্রিলের কোনো এক দিন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপসী রাবেয়া হলের ৩৩০ নম্বর কক্ষের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। এখানে দাঁড়ালে ব্রহ্মপুত্রের বয়ে চলা দেখা যায়। ব্রহ্মপুত্র সারা দিন এক রকম, সন্ধ্যায় অন্য রকম। কিছুদিন হলো মুঠোফোন কিনেছি। রাতের শান্ত ব্রহ্মপুত্রের সামনে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনের পর্দায় মাঝেমধ্যে আম্মুর চুলহীন কিছু ছবি দেখছি। ছবিগুলো সম্প্রতি তোলা, কেমোথেরাপির পরপরই।

সন্ধ্যা সাতটা কি সাড়ে সাতটায় একটা কল এল, দু-এক দিন পরপর কলটা আসে। যতটা পারি গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে রিসিভ করি, ‘হ্যালো, আব্বু।’

‘না চৈতী, আমি...শুভ জন্মদিন।’

আম্মু! কেমন আছ? গলা শুনে মনে হচ্ছে আজ তুমি পুরো সুস্থ।

ফোনের ওপাশে প্রাণখোলা হাসির শব্দ শুনতে পাই। কিন্তু আমার জন্মদিন আজ নয়, কাল। আম্মু আগেভাগে শুভেচ্ছা জানাল কেন?

আমার ভেতরের কথাটা আব্বু টের পেল। একদিন আমাকে ডেকে বলল, ‘আর বেশি দিন না চৈতী। যে কয়টা দিন আছে নেড়েচেড়ে নাও। চলে গেলে আর পাবে না।’

‘অত রাতে আর কল দিতে পারব না, তাই। আর শোন, খুব ভালো করে পড়াশোনা করবি, অনেক বড় হতে হবে। বোকার মতো কাঁদবি না। এখন রাখি, টায়ার্ড লাগছে।’

হু হু করে কান্না আসছে। কান্না চেপে আব্বুকে ফোনটা দিতে বলি। তাঁর সঙ্গে কথা বলি।

এর ঠিক দুই দিন পর আব্বু জানায়, আম্মুকে ভারতের চিকিৎসকেরাও ফিরিয়ে দিয়েছেন। দেশে নিয়ে যেতে বলেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার মধ্যেই বাড়ি চলে এলাম। সারা দিন আম্মুর পাশে থাকি। প্রয়োজনীয় সবকিছু তখন বিছানাতেই করেন। দিনে দিনে কেন জানি খুব ক্লান্তি বোধ করতে লাগলাম। সন্তান হয়েও মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের যত্ন নিতে পারছিলাম না। সকালে ইচ্ছা হয় আরেকটু ঘুমাই, আম্মুর পাশে বসে থাকাটাও একটা শাস্তি মনে হওয়া শুরু হলো।

আমার ভেতরের কথাটা আব্বু টের পেল। একদিন আমাকে ডেকে বলল, ‘আর বেশি দিন না চৈতী। যে কয়টা দিন আছে নেড়েচেড়ে নাও। চলে গেলে আর পাবে না।’

ঠিক দুই দিন পর, ১৭ মে সন্ধ্যায় নিশ্চুপ নিস্তেজ হয়ে গেল আম্মু। রাত আড়াইটার দিকে সবাই বলতে শুরু করল আম্মু মারা গেছে। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে আম্মু শ্বাস নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ে বুকে মাথা রেখে জোর করে বোঝাচ্ছি আম্মু বেঁচে আছে, আম্মু কি করে মারা যাবে? কেন যাবে?

আজ ১৫ বছর আম্মু নেই। প্রতিবছর মা দিবসের ডামাডোলের মধ্যে আমি আম্মুর মৃত্যুবার্ষিকীর পরিকল্পনা করি।

‘কাঁদবি না,’ তোমার এই কথা বোধ হয় রাখতে পারব না। আমি এখনো কান্নাকাটি করি।

ভালো থেকো মা।