‘কথা মানুষকে কাছে টানে, কথা মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়। কথা মানুষকে বন্ধু করে। কথা মানুষকে শত্রু করে।’ রবীন্দ্রসাধক ওয়াহিদুল হকের এই কথা থেকে শুধু নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যাপন থেকেও আমরা হামেশাই উপলব্ধি করতে পারি, মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ এবং মানুষের কাছে নিজেকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কথা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কথা যদি হয় সুন্দর ও সাবলীল, তাহলে তা মানুষের ব্যক্তিত্বে দান করে অন্য রকম সৌকর্য। আবার সেই কথাই যদি হয় জড়ানো ও অসম্পূর্ণ, তাহলে তা মানুষের ব্যক্তিত্বকে করে দেয় ম্লান।
বক্তৃতা হোক বা নিবিড় কোনো আলাপচারিতা—সুন্দর করে কথা বলা মানুষের কদর সর্বত্র।
শুধু সুন্দর করে কথা বলতে না পারার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে নিজের পেশাগত ও ব্যক্তিজীবনেও। কারণ, নিজেকে ঠিকভাবে তুলে ধরা এবং মনের ভাব বা বক্তব্য প্রকাশ করার প্রথম ধাপই হলো কথা।
আবৃত্তিকার মাসকুর-এ-সাত্তার বলেন, মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন হচ্ছে কথা। চর্চা বা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সুন্দর করে কথা বলার অভ্যাস করা যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোনোক্রমেই তা যেন আরোপিত বা কৃত্রিম না হয়ে যায়।
আবার বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আবৃত্তিশিল্পী অনন্যা লাবনী বলেন, ‘শুদ্ধ উচ্চারণে ও গুছিয়ে কথা বলার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সহজেই মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ ও আস্থা অর্জন করা যায়। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পেশাগত জীবনে সংশ্লিষ্ট সবার আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরতা অর্জনে কথা বলার নান্দনিকতা ও সৌন্দর্য অনেক বড় প্রভাব বিস্তার করে। শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ–আলোচনা সহজ ও বোধগম্য করতে নিঃসন্দেহে সুবচন সাহায্য করে। টেবিল টকেও কথার সৌন্দর্য অপর পক্ষকে মুগ্ধ করতে যথেষ্ট সহায়ক। এ কারণে অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বা বাইরে এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কর্তৃপক্ষ সুভাষী কাউকেই নির্বাচন করে। বচন যেহেতু যোগাযোগের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম, কাজেই স্বাভাবিকভাবেই উৎকৃষ্ট বচনধারীর কদর সবখানেই থাকে।
সুন্দর করে কথা বলার বেশ কিছু কৌশল বা ধাপ আছে, যার কিছু কিছু চর্চার মাধ্যমে আয়ত্ত করতে হয়, আর কিছু কিছু গড়ে ওঠে নিজের জীবনাচরণ ও বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। চলুন ধাপগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই।
শুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণ
প্রথমেই আসে শুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণ। ভুলভাল উচ্চারণ ও অস্পষ্টতা বদলে দেয় শব্দের অর্থ। এ ধরনের ভুল শ্রোতার ভেতরে বিরক্তির সৃষ্টি করে এবং বক্তাও হয়ে ওঠেন বিরক্তিকর।
আরামদায়ক গতি
কথা বলার সময় বাক্প্রত্যঙ্গে জড়তা থাকলে বা তাড়াহুড়া করে বলার প্রবণতা থাকলে উচ্চারিত শব্দগুলো সম্পূর্ণ হয় না। এতে কথা থেকে যায় অস্পষ্ট। কথার ভেতরে শব্দগুলো যেন পূর্ণ ও স্পষ্ট শোনা যায়, সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার। আবার বেশি ধীরগতিও একধরনের জড়তা, যা বক্তার প্রতি শ্রোতার মনোযোগ নষ্ট করে, বক্তব্যকে করে তোলে একঘেয়ে।
বক্তব্য হবে পরিষ্কার ও সংক্ষিপ্ত
কথা বলার সময় দীর্ঘ বর্ণনা, ব্যাখ্যা বা অপ্রাসঙ্গিক বিবরণ এড়িয়ে চলা উচিত। শ্রোতার আগ্রহ ধরে রাখার জন্য বক্তব্য সংক্ষিপ্ত ও সুনির্দিষ্ট হওয়া ভালো। বিশেষ করে পেশাগত ক্ষেত্রে। অকারণ এলোমেলো কথা বলতে থাকলে মূল বক্তব্য হারিয়ে যায়, শ্রোতাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
কথার ফাঁকে রসবোধ
একটানা গুরুগম্ভীর কথা শুনতে ভালো লাগে না। রসকষবিহীন কাঠখোট্টা মানুষ বা আলাপ—কোনোটাই আমাদের ভালো লাগে না। বরং কথার ফাঁকে ফাঁকে হালকা একটু হাসির কথা, মজার কোনো ঘটনা বা কৌতুক, বন্ধুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি ইত্যাদি বক্তার সরসতা প্রকাশ করে। তবে অবশ্যই সেই মজার কথা হতে হবে প্রাসঙ্গিক, শালীন ও বুদ্ধিদীপ্ত।
বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা থাকলে ব্যক্তির কথায় সেটি ফুটে ওঠে। এ প্রসঙ্গে জনপ্রিয় উপস্থাপক ও কণ্ঠশিল্পী শারমিন লাকী বলেন, বই পড়া, লেখা, গান শোনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল তাঁর রুচিবোধ, ভাষা ও শব্দ চয়ন। বাড়িতে মা, মামা ও ভাইয়েরা বিভিন্ন ভাষার গান শুনতেন। এভাবে তৈরি হয়েছিল তাঁর কান। সুন্দর জিনিস শুনতে শুনতেই সুন্দর কথা বলার মন ও মগজ তৈরি হয়ে যায়। তা ছাড়া তিনি ছোটবেলায় সব সময় জোরে জোরে উচ্চারণ করে পড়তেন। নিজের কণ্ঠ ও কথা নিজেই শুনতেন। এই বিষয়গুলো তাঁকে সুন্দর করে কথা বলতে সাহায্য করে।
আপনি যখন কথা বলছেন, তখন শ্রোতা কী শুনতে চান, কীভাবে শুনতে চান, সেটি বোঝাও জরুরি। শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখতে না পারলে তাঁর কাছে যেকোনো কথার উপস্থাপন বৃথা হয়ে যেতে পারে।