আমাদের ‘বিড়ালের মতো’ বন্ধুত্ব

বিদেশ বন্ধুদের সঙ্গে লেখক (বাঁ থেকে তৃতীয়)
ছবি: সংগৃহীত

বিভিন্ন দেশের নানা ধরনের মানুষ এক হলে যে কী চমৎকার একটা বন্ধুত্ব হতে পারে, বিদেশে পড়তে না এলে জানাই হতো না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকের পরপরই ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তি পেয়ে আমি চলে আসি পর্তুগালের ইউনিভার্সিটি অব ইভোরাতে। সেখানে কনজারভেশন বায়োলজি নিয়ে পড়েছি। কারণ, পরিবেশ নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল ছোটবেলা থেকে।

স্নাতকোত্তরে অনেক নতুন বন্ধু হলো যারা আমার মতোই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে। আমরা সবাই একই সঙ্গে নতুন ভাষা শিখতে শুরু করি। পর্তুগিজ বন্ধু মারিয়া আমাদের সাহায্য করত। জার্মানির ক্রিস, স্পেনের জোয়ানা, ন্যান্সি, আনার সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল দ্রুত। ছুটির দিনে আমরা ঘুরতে যেতাম। ইরাসমাস বৃত্তির মজাটা এখানেই। নানা দেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করাও যেন এই বৃত্তির একটা অংশ।

স্নাতকোত্তরের পরপরই মেরি কুরি ফেলোশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে আসি স্পেনের অপূর্ব শহর—সেভিয়াতে। আরও ১০ দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্প্যানিশ ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিলে শুরু হয় আমার যাত্রা।

ইউরোপিয়ান ফেলোশিপের মূল ভাবনাই হলো ‘মোবিলিটি’। অর্থাৎ কিছুদিন পরপরই এক দেশের ‘সামার স্কুল’, আরেক দেশের সম্মেলন কিংবা ল্যাবের কাজে ছুটতে হয়। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নানা দেশের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বটা জোরালো করে।

গবেষণা আর মাঝখানে কোভিড বিড়ম্বনায় আমার সঙ্গে ইতালির আইরিস সামারকোর খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। ওকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওর কাছে বন্ধুত্ব মানে কী? বলল, এই যে ল্যাবে গবেষণা করতে করতে তর্ক করা, সপ্তাহের শেষে ওর কাছে পাস্তার রেসিপি শেখা, আর একসঙ্গে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যাওয়া—এসবই তো বন্ধুত্ব। স্পেনের রুবেন মার্টিনের মতে, বন্ধুত্ব হলো তুমুল ঝগড়ার পরও একসঙ্গে কফি খেতে খেতে এমনভাবে গল্প করা, যেন কিছুই হয়নি!

বিদেশে পড়ার সুবাদেই নানা দেশের নানা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে

ল্যাবের সুপারভাইজার ৪৯ বছর বয়সী মনিকা মেডরানোর সঙ্গেও আমার বেশ ভালো বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব যে বয়স মানে না, মনিকা তার প্রমাণ। স্পেনে আসার পর থেকে সব সময় সে আমার খোঁজখবর রাখেন। বন্ধুত্বের খাতিরেই আমি তাঁকে ‘সেকেন্ড মাদার’ নামে ডাকি। বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে বাজারে কোথায় কী পাওয়া যায়, সব গল্প তো তাঁর সঙ্গেই জমে।

পিএইচডি প্রোগ্রামে আমার বন্ধুত্ব হয় বেলজিয়ামের মর্গান ভ্যান আন্ত্রোর সঙ্গে। হাসিখুশি মানুষ। একদিন বলছিল, মানুষের জীবনে বন্ধুত্ব হলো ডিএনএর মতো। প্যাঁচানো কিন্তু অনেক অর্থবহ। জার্মানিতে আমরা দুজন একবার সায়েন্স কমিউনিকেশন অফিসে ইন্টার্নশিপ করতে গিয়েছিলাম। সেখানে বাচ্চাদের জন্য আমরা একটা গেম ডিজাইন করেছিলাম, আর ছোটবেলার মজার মজার স্মৃতি রোমন্থন করেছিলাম। তখন বুঝলাম, আমরা আলাদা আলাদা মহাদেশে বড় হলেও ছোটবেলার অনুভূতিগুলো আসলে একই রকম।

স্পেনে এখন আমি গবেষণা করি ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি ল্যাবে। এখানে জাভিয়ের পুই, বারবার রদ্রিগেজ আমার ভীষণ ভালো বন্ধু। বারবারা আবার ভীষণ বিড়ালভক্ত। টুইটারের বায়োতে সে লিখে রেখেছে, ‘প্ল্যান্ট লেডি ইজ দ্য নিউ ক্যাট লেডি’। গাছপালা, প্রকৃতি–প্রাণও ভীষণ পছন্দ করেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘আমার বন্ধুত্ব বিড়ালের সঙ্গে। বিড়াল যেমন আদুরে, বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলোও তেমনি যত্নে রাখতে হয়।’

বন্ধু অ্যাডাম নান থাকে যুক্তরাজ্যে। ব্রিটিশ বলে ক্রিকেট-ফুটবল খেলা নিয়ে বেশ আগ্রহ তার। আমাদের দলে আমরা ক্রিকেট বুঝি দুই–তিনজন। তাই আমাদের গল্পটা বেশ জমে। আরেক বন্ধু, ভূমিকা দুবে এসেছে ভারত থেকে। সপ্তাহের শেষে নতুন খাবারের সন্ধানে নতুন নতুন শহরে ঘুরে বেড়ানো, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয় আমাদের। মাঝেমধ্যে আমরা সিনেমা দেখি। সবার যে সব পছন্দ হয়, তা নয়। কিন্তু বন্ধুত্বে অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়—এটা বলেছে আমার বন্ধু ক্রিস্টিয়ান পন্টন, সে থাকে নেদারল্যান্ডসে।

আমরা বন্ধুরা মিলে কনসার্টে যাই। সেভিয়ার বিখ্যাত ফ্লামেঙ্কো মিউজিকের আসর থেকে শুরু করে গানস এন রোজেসের কনসার্ট—সব জায়গায় যাই একসঙ্গে। গানের ভাষা যা-ই হোক, সবাই মিলে তাতে গলা মেলাই। বন্ধুত্ব ব্যাপারটাও আসলে এমন। ভাষা না মিলুক, সুর মেলালেই হলো।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, মেরি কুরি ফেলো, স্প্যানিশ ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল, স্পেন