ভাবছেন এ আবার কেমন সমীকরণ। অত না ভেবে পত্রিকা, অনলাইন বা টিভি চ্যানেলে একটু চোখ বোলান। ধর্ষণ: প্রায় রোজই তিন বর্ণের ভয়ংকর শব্দটি খুঁজে পাবেন।
তবে রোজ দেখতে দেখতে ভয়ংকর এ ঘটনাও এখন যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রধান শিরোনাম হতে না পারলে বা খুব বেশি আলোচনা না হলে ধর্ষণের শিকার নারী বা ঘটনাটি আমাদের খুব বেশি আলোড়িত করে না। অনেক ক্ষেত্রে শিরোনাম দেখে খবরের ভেতরেও আর আমরা যাই না।
তবে একটু পড়লেই বোঝা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনার শিকার নারীটি ছিলেন একা। এই যেমন ৮ অক্টোবর নেত্রকোনা থেকে ঢাকা এসেছিল ১৭ বছরের এক কিশোরী, কমলাপুরে স্টেশনে একা বসে ছিল সে। নিরাপদ জায়গায় নেওয়ার কথা বলে ছয়জন তাকে ট্রেনের ভেতরে নিয়ে ধর্ষণ করে।
আবার ধরা যাক শুক্রাবাদে ধর্ষণের শিকার অন্তঃসত্ত্বা সেই নারীর কথা। বাসায় গিয়ে রূপচর্চাসেবা দিতেন তিনি। কৌশলে শুক্রাবাদের বাসায় ডেকে নিয়ে তাঁকে মারধর ও ধর্ষণ করেন তিন তরুণ। এ কাজে তাঁদের আবার সহায়তা করেন আরেক নারী। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যাওয়া কুমিল্লার তনু, রূপা—এ রকম নাম ও ঘটনার তালিকা সীমাহীন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা ছিলেন একা।
ছোটবেলায় মফস্সল শহরে দেখতাম, বড় বোনকে স্কুল বা কলেজে নিয়ে যেতে পাহারাদার হিসেবে সঙ্গে যেত তার চেয়ে বয়সে ঢের ছোট ভাইটি। বন্ধু, স্বজনের মধ্যে কোনো কোনো কিশোরী খুব রেগে যেত। সক্ষোভে বলত, তিন আঙুলের ওই ভাইটি কেন তার পাহারাদার হবে। সে কি একা চলতে পারে না? এখন বুঝি মা, খালা, চাচিরা কোন শঙ্কায় ভুগতেন।
এই তো ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে রাজধানীসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে। গরমে ঘরে টিকতে না পেরে ১১ বছরের মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। অন্ধকারে একটি গলিতে ঢুকে পড়েছিলাম। অনেকটা ফাঁকা, আলো–আঁধারি সেই গলিতে অজানা ভয়ে হাত, পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। আশপাশে হাতে গোনা কয়েকজন পুরুষও যেন তখন শত্রু হয়ে গেল। এই বুঝি কেউ বিপদে ফেলবে।
তিন–চার দশক আগে বড় বোনের সঙ্গে ছোট ভাইকে পাহারাদার হিসেবে স্কুলে যেতে দেখে হেসে কুটিকুটি হয়েছি। আর এখনো দেখি মেয়ের হাত ধরে স্কুলে, কলেজে নিয়ে যান অভিভাবকেরা। এমনকি বেশি রাত হলে অফিস থেকে এসে নারীকে নিয়ে যান বাবা অথবা স্বামী। কারণ, মনের ভেতরে লুকিয়ে আছে ভয়ের সেই সমীকরণ। নারী+একা = ধর্ষণ। দশকের পর দশক, যুগের পর যুগ ধরে চলা এ দৃশ্যপট কি বদলাবে না!
ব্যাপারটা এমনও নয় যে নারী কেবল একা থাকলেই ধর্ষণের শিকার হন। স্বামীর সামনে স্ত্রী, মায়ের সামনে মেয়ে, বন্ধুর সামনে বান্ধবী ধর্ষণের ঘটনাও কি কম? গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের শিকার হন ২০ বছরের এক নারী।
ভারতে ২০১২ সালে রাতে সিনেমা দেখে বন্ধুর সঙ্গে ফেরার সময় চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন প্যারামেডিকেল ছাত্রী। ধর্ষণের আগে তাঁর বন্ধুকে পিটিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়। বীভৎস নির্যাতন করা হয় তাঁর ওপর। পরে তিনি মারা যান। গণমাধ্যমে তিনি পরিচিত হন ‘নির্ভয়া’ নামে।
আলোচিত এ ঘটনার পর নির্মিত হয় তথ্যচিত্র ইন্ডিয়াজ ডটার। সেখানে কারাগারে থাকা সাজাপ্রাপ্ত ‘নির্ভয়া’র একজন ধর্ষণকারীকে আমরা বলতে শুনেছি, ‘ভদ্রঘরের মেয়েরা রাত ৯টার পরে বাইরে থাকে না।’ আসামিপক্ষের আইনজীবীকে আমরা বলতে শুনি, ‘নারী হচ্ছে হীরার মতো মূল্যবান। যদি রাস্তায় হীরা ফেলে রাখা হয়, তাহলে কেউ না কেউ তা তুলে নেবে।’
দুঃখজনক হলেও সমাজে অনেকেরই কমবেশি এ মনোভাব। তাই তো গণমাধ্যমে ধর্ষণের খবরের পিঠে আসা মন্তব্যেও আঙুল তোলা হয় ঘটনার শিকার নারীর দিকেই। ‘রাতবিরাতে নারী কেন বাইরে যাবে।’ ‘নারীর এত বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানোর দরকার কী।’ ‘নারীর পোশাক এ রকম হলে তো এ ধরনের ঘটনা ঘটবেই।’ সত্যিই সমীকরণটা তো আমাদের জানা। নারী+একা = ধর্ষণ। তাহলে কি ঘরে ঢুকে পড়াই সমাধান? ঘরেও কি নারী নিরাপদ? উত্তরটা আমার জানা নেই। কেউ কি জানেন?