১৩২ দেশের ২২ হাজারের বেশি দেশলাই বাক্স সংগ্রহ করেছেন সাকিল হক। সেসব নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের ভাড়া বাসায় গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত ‘ম্যাচবক্স মিউজিয়াম’। দেখে এসেছেন এস এস আল আরেফিন
কক্ষটার চারপাশে লম্বা লম্বা কাচের আলমারি, মাঝেও রাখা আছে তাক। এসব আলমারি আর তাক ভরা খালি দেশলাই বাক্স। ধরন অনুযায়ী আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে ১৩২ দেশের প্রায় ২২ হাজার দেশলাই বক্স। কোনোটি স্বচ্ছ পাতলা প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে, কোনোটি প্লাস্টিকের বাক্সে রেখে।
সাকিল হক বললেন, ‘শীতপ্রধান দেশে ম্যাচবক্স সংরক্ষণ করা সহজ। কিন্তু আমাদের দেশে কঠিন। ম্যাচবক্সের যে অংশে কাঠি ঘষে আগুন জ্বালানো হয়, সেটি নষ্ট হয়ে যায়।’ সে জন্য দেশলাই বাক্সের উপাদান বুঝে আলাদাভাবে সংরক্ষণ করেন তিনি।
সাকিল হকের বাবাও ছিলেন শখের সংগ্রাহক। নানা ধরনের জিনিস সংগ্রহ করতেন। সেখান থেকেই দেশলাইয়ের প্রতি আগ্রহ। শৈশবে সংগ্রহ শুরু হলেও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে সে সময়ের দেশলাই বাক্সগুলো পরে নষ্ট হয়ে যায়। মাঝে একটা দীর্ঘ বিরতি। ২০১২ সাল থেকে আবার পুরোনো শখ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এবার পুরোদমে শুরু করেন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।
বিভিন্ন দেশের দেশলাই সংগ্রহ করতে করতে একসময় নিজের দেশের দেশলাই বাক্স নিয়েও ভাবতে শুরু করেন সাকিল হক। নিজেও তিনি গ্রাফিকস ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। তাই সুন্দর নকশা করে বিভিন্ন দেশলাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছেও গেছেন। দুটি প্রতিষ্ঠান তাঁর ১৫টি নকশা নিয়ে দেশলাই বাক্স বানিয়েছে। বিনা মূল্যে সরবরাহ করা এসব নকশা ছাড়াও সংগ্রাহকদের জন্য বা নিজের শখ পূরণ করতেও পাঁচ শতাধিক দেশলাই বাক্সের ডিজাইন করেছেন তিনি। নিজ খরচে যা উৎপাদনও করছেন। সাকিলের ডিজাইনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, চে গুয়েভারা, মাইকেল জ্যাকসন, মেরিলিন মনরোর মতো ব্যক্তিত্বদের ফুটিয়ে তুলেছেন। চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের চিত্রকর্ম ব্যবহার করেও তিনকোনা দেশলাইয়ের নকশা করেছেন তিনি। এসব সংগ্রহ নিয়ে ২০১৮ সালে ঢাকার দৃক গ্যালারিতে একক প্রদর্শনী করেন সাকিল। তিনি বললেন, ‘আমার সংগ্রহের সব দেশলাই সচল। তাই যত্নে রাখতে হয়। ভবিষ্যতে স্থায়ী জায়গায় পরিপূর্ণ একটি জাদুঘর করতে চাই। যেখানে বাইরের মানুষেরাও এসে দেখতে পারবে।’
চলুন, দেখে নেওয়া যাক সাকিল হকের সংগ্রহের বিচিত্র কিছু দেশলাই বাক্স—
সবচেয়ে বড় ম্যাচ
পোল্যান্ডের এই দেশলাই বাক্স প্রায় ২০ বছর আগে বাজারে এসেছিল। এটি সাকিলের সংগ্রহে সবচেয়ে বড় দেশলাই বাক্স। দেশলাইটি মূলত ফায়ারপ্লেস জ্বালানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। এক হাজার কাঠির বাক্সটির একেকটি কাঠির আকার ১০ ইঞ্চি। পোল্যান্ডের এই দেশলাই বাক্স তিনি স্লোভেনীয় সংগ্রাহক স্যান্ডি নোভিনিকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন।
সবচেয়ে ছোট ম্যাচ
এক ইঞ্চির চার ভাগের এক ভাগেরও ছোট আকারের দেশলাই বাক্সটিই সাকিলের সংগ্রহের সবচেয়ে ছোট দেশলাই বাক্স। সাকিল বললেন, নির্মাতার দাবি অনুযায়ী এই দেশলাই বাক্স বিশ্বে মাত্র দুটি আছে। অন্যটি আছে ভারতের মহারাষ্ট্রের ভোপালের সংগ্রাহক সুনীল ভাটের কাছে। বিশ্ব রেকর্ড গড়ার জন্য দুটি ম্যাচ তৈরি করিয়েছিলেন সুনীল। তিনিই পরে দেশলাই বাক্সটি সাকিলকে দিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দেশলাই
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাঠ জ্বালানোর কাজে ব্যবহৃত হতো, সাকিলের সংগ্রহে এমন একটি দেশলাই বাক্সও আছে। সুইডেনের একটি নিলাম থেকে দেশলাই বাক্সটি কিনেছেন তিনি। এই দেশলাইয়ের কাঠিগুলো ঝাড়বাতির কাঠির মতো। প্রতিটি কাঠির গায়ে বারুদের মোটা ও লম্বা প্রলেপ দেওয়া।
রাজপরিবারের ম্যাচ
যুক্তরাজ্যের রাজপরিবার থেকে বিভিন্ন উৎসব-আয়োজনে দেশলাই বাক্স তৈরি করা হতো। ১৯৭৫ সালে রানিমাতা এলিজাবেথের (১৯০০–২০০২) ৭৫তম জন্মদিনে রাজপরিবারের তৈরি করা বিশেষ দেশলাই বাক্সটি সাকিলের সংগ্রহশালায় আছে। দেশলাই বাক্সটির পেছন দিকে ১৯০০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বিশেষ ঘটনার তালিকা দেওয়া আছে। দেশলাই বাক্সের ট্রে বা কাঠি রাখার জায়গাটি কাঠের তৈরি।
দুর্লভ ম্যাচ
১৮ শতকের শুরুর দিকে ইংরেজ আবিষ্কারক জন ওয়াকার (১৭৮১-১৮৫৯) প্রথম ঘষা দিয়ে আগুন জ্বালানোর ম্যাচ আবিষ্কার করেন। সে সময়ের একধরনের দেশলাই সাকিলের সংগ্রহে আছে। দৃষ্টিনন্দন বাক্সের ভেতর হলুদ কাপড় দিয়ে সযত্নে রাখা আছে ম্যাচগুলো। এখনকার ম্যাচের গায়ে লেখা থাকে নিরাপদ ম্যাচ। কিন্তু সাকিলের সংগ্রহে থাকা সেই ম্যাচকে নিরাপদ বলা হতো না। কারণ, পকেটে ঘষা লেগেই তাতে আগুন লেগে যেত।