সুখবরটা শিরোনামেই পেয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। বিজয়ী দলের নাম অ্যাপোক্যালিপস। আর সদস্যরা পড়েন ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ইউআইইউ)। ২২ নভেম্বর ইউআইইউর মাদানী অ্যাভিনিউর ক্যাম্পাসেই তাঁদের সঙ্গে কথা হলো।
১৫ থেকে ১৭ নভেম্বরে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে বসেছিল ব্লকচেইন অলিম্পিয়াডের ষষ্ঠ আসর। প্রতিযোগিতায় ইউআইইউর প্রকল্পটির নাম ছিল ‘আইপি ব্লকচেইন প্রো’। দলের সদস্যরা হলেন সাদিয়া আহম্মেদ, জিশানুল ইসলাম ও সাহিদ হোসেন। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সঙ্গে ছিলেন আদিবা তাসনিমও। সবাই কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। এবারের প্রতিযোগিতার আয়োজক ছিল হল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস। প্রকল্পের প্রভাব, বিশ্বস্ততা ও বাণিজ্যিক বাস্তবায়নের সক্ষমতা—তিনটি বিষয় বিবেচনা করে চ্যাম্পিয়ন দলকে দেওয়া হয় ২ হাজার ৪০০ ইউরো (আড়াই লাখ টাকার বেশি)।
যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, হংকং, ভারত, বাংলাদেশসহ ১৯টি দেশ ও ইউরোপ অঞ্চলের প্রায় ৫০টি দল এবার অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ থেকে মোট ১১টি দল আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে আমন্ত্রণ পেলেও ভিসা-জটিলতায় শেষ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডস পৌঁছাতে পেরেছিল পাঁচটি দল। অনলাইনে যুক্ত ছিল আরও চারটি দল। অ্যাপোক্যালিপস ছাড়াও ইউআইইউর দল ‘টিম আনচেইনড’, সিলেট ক্যাডেট কলেজের ‘গ্রেদেভস’, ‘বি-ক্রিপট’, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চুয়েট অ্যানোনিমাস’ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির দল ‘ব্লকবিট’ জিতেছে মেরিট অ্যাওয়ার্ড। ফাইনালে ১১তম থেকে ২০তম অবস্থান পাওয়া দলগুলোকে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ইউআইইউর প্রভাষক তারেক হাসানের পরামর্শে একরকম হুট করেই ব্লকচেইনের চর্চা শুরু করেছিলেন সাদিয়া, জিশান ও সাহিদ। যেহেতু প্রথম বর্ষ থেকেই তিনজন একসঙ্গে কাজ করেছেন, জিতেছেন নানা পুরস্কার, তাই দলের মধ্যে বোঝাপড়া ভালো ছিল আগে থেকেই।
ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের চতুর্থ আসরের ফাইনালে রৌপ্য জিতেছিলেন তাঁরা। তবে পুরস্কার নিতে যাননি কেউই। কেন? প্রশ্ন শুনে তিনজনই হেসে ফেললেন। দলনেতা সাদিয়ার উত্তর, ‘জেতার কথা আমাদের ভাবনায়ও ছিল না। আমি বাসায় বসে অনুষ্ঠানটার লাইভ দেখছিলাম। হঠাৎ আমাদের নাম ঘোষণা হলো। সঙ্গে সঙ্গে দুজনকে ফোন দিলাম। ওরাও আকাশ থেকে পড়ল। সাহিদ বোধ হয় ঘুমাচ্ছিল। ওকে যখন দ্বিতীয় হওয়ার কথা জানালাম, ঘুমের ঘোরেই ও বলছিল, “পুরস্কার! কোথায়, কখন?” হা হা!’
এই পুরস্কারই তাঁদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল।
প্রোগ্রামিংয়ের একটা কোর্স করানোর সময় এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার পরিচয়। খেয়াল করছিলাম, শুধু গ্রেডের জন্য না, যেকোনো সমস্যার সমাধান এবং বাস্তব ক্ষেত্রে সেটার প্রয়োগ জানার ব্যাপারে ওদের অনেক আগ্রহ৷ আমি শুধু এই আগ্রহ বাড়াতে সাহায্য করেছি। পরপর তিনবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করল ইউআইইউ। ওদের এই অর্জন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি শিক্ষার্থীদেরও অনুপ্রাণিত করবে।সুবংকর কর্মকার, অ্যাপোক্যালিপস দলের পরামর্শক ও ইউআইইউর কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক
প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্বটা নিলেন জিশানুল ইসলাম। বললেন, ‘ব্লকচেইন একধরনের ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার, সবার জন্য যেটি উন্মুক্ত। আমাদের আশপাশের প্রায় সবকিছুই কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যেমন গুগল, ব্যাংক, ফেসবুক ইত্যাদি। কয়েকজন মানুষ এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা থাকে, কনটেন্টের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। সাতোশি নাকামোটো ছদ্মনামে এক ব্যক্তি ব্লকচেইনকে ব্যবহার করে নতুন এক সমাধান আবিষ্কার করেন। তিনি বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা দেন। এখানে কোনো একক ব্যক্তি সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ না করে, অনেকগুলো কম্পিউটার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় এবং তৃতীয় পক্ষ ছাড়াই এ কাজ চলতে থাকবে।’
বাংলাদেশের জন্য কেন এই সিস্টেম গুরুত্বপূর্ণ, সেটিও বুঝিয়ে বললেন জিশান, ‘এটা ডেটা সংরক্ষণ করে, ডেটার নিরাপত্তা দেয়। এই যে কিছুদিন আগে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ফাঁস হলো, ব্লকচেইনের মাধ্যমে এই তথ্য ফাঁস রোধ করা যেত। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব ডেটার আদান-প্রদান ও নিরাপত্তায় এই সিস্টেম কাজে লাগানো উচিত।’
প্রকল্পের ভাবনাটা দাঁড় করাতে কত খাটাখাটনি করতে হয়েছে, সে কথা বলছিলেন সাহিদ হোসেন, ‘জাতীয় পর্যায়ের অলিম্পিয়াডের আগে বেশি সময় ছিল না। মিড শেষ করে টানা ৩২ ঘণ্টা না ঘুমিয়ে আমরা প্রকল্প জমা দিয়েছি। ৩টি জিনিস দিতে হয়েছে—১০ মিনিটের ভিডিও, পিচ ডেক ও পেপার।’ তবে আন্তর্জাতিক পর্বে পৌঁছে সাহিদরা বুঝতে পারেন, সেখানকার বিচারকের মাপকাঠি ঠিক বাংলাদেশের মতো নয়। তাই নতুন করে তাঁরা পিচ, প্রেজেন্টেশন তৈরি করেন। সাহিদ বলেন, ‘খুব দ্রুত আমাদের কাজ করতে হয়েছে। ওখানে পরিবেশ আসলে অন্য রকম। অনেক প্রতিযোগী ছিল, যারা ব্লকচেইনের কোম্পানিতে কাজ করে। তারা অনেক এগিয়ে। হংকংয়ের দলগুলোকে দেখে বেশি অবাক হয়েছি। ওদের একটা দলে ১৪ বছর বয়সী একজনের ব্লকচেইন নিয়ে যা জ্ঞান দেখলাম, তা অবিশ্বাস্য।’
এত তুখোড় প্রতিযোগীদের হারিয়ে কোন আইডিয়া বাংলাদেশ দলকে চ্যাম্পিয়ন করল? সাদিয়া বুঝিয়ে বলেন, ‘মেধাস্বত্ব বলতে আমরা বুঝি পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক বা নতুন কোনো আবিষ্কার। বাংলাদেশে এই মেধাস্বত্ব-সংক্রান্ত সিস্টেমগুলো ম্যানুয়াল, এবং অনেক সময়সাপেক্ষ। একটু হোমওয়ার্ক করে আমরা জেনেছি, শুধু বাংলাদেশে না, বিশ্বের আরও অনেক দেশেই কাজটা সময়সাপেক্ষ। ফলে এ সময়ের মধ্যে কারও আইডিয়া চুরি হয়ে যেতে পারে। আমরা মেধাস্বত্বের জন্য একটা ইকোসিস্টেম তৈরি করতে চেয়েছি, যেন খুব সহজে, কম সময়ে ও নিরাপদভাবে পেটেন্ট বা রেজিস্ট্রার করা যায়।’
সাদিয়াদের প্রকল্পটি বার্সেলোনার কয়েকজন বিনিয়োগকারীর এতই পছন্দ হয়েছে যে তাঁরা অ্যাপোক্যালিপসের সদস্যদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন, লিংকডইনে যুক্ত হয়েছেন। তবে সুযোগ পেলে আগে দেশের জন্য কাজ করতে চায় দলটি।