সুর কৃষ্ণ চাকমা। বাংলাদেশের প্রথম বেল্টপ্রাপ্ত পেশাদার বক্সার। এশিয়ান বক্সিং ফেডারেশনের টাইটেল তালিকায় যুক্ত হয়েছে তাঁর নাম। গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকায় নেপালের বক্সার মহেন্দ্র বাহাদুর চাঁদকে হারিয়ে এই বিশেষ পেশাদার বেল্ট জিতেছেন সুর। এখন থেকে প্রতি তিন মাসে যেকোনো পেশাদার বক্সার তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন। নিজেও সমকক্ষ যেকোনো বক্সারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন সুর।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে এরই মধ্যে এক পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন সুর কৃষ্ণ। বিভিন্ন কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের কাছ থেকে শুভেচ্ছাদূত হওয়ার প্রস্তাব পাচ্ছেন তিনি। অথচ খেলা শুরুর পর প্রথম দিকে নিজেও ভাবতে পারেননি কোনো একদিন এতটা দূর আসতে পারবেন।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান সুর কৃষ্ণ চাকমা। একই সময়ে তাঁর এইচএসসি পরীক্ষাও পড়ে। তারপরও বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিয়ে স্বর্ণপদক জেতেন সুর। এরপরই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। জায়গা পান জাতীয় দলে। পরের বছর হন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। অথচ তাঁর বক্সিংয়েই আসার কথা ছিল না। অনেকটা হুট করেই বক্সিংয়ে নাম লেখান তিনি। ২০০৬ সালে রাঙামাটিতে একটি ট্যালেন্ট হান্টের আয়োজন করে বিকেএসপি। সেখানে ফুটবলের ট্রায়াল দিতে গিয়েছিলেন ছোট্ট সুর। তবে ফুটবলে জায়গা করে নিতে পারেননি। কিন্তু পরিবারের চাওয়া ছিল বিকেএসপিতেই ভর্তি হোক ছেলে, তাহলে পড়াশোনা আর খেলাধুলা দুটিই চলবে। তাই তালিকার একদম শেষ দিকে থাকা বক্সিংয়েও আরেকটি ট্রায়াল দিলেন সুর। পোস্টারে শুধু দেখলেন দুজন লোক ঘুষি মারার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তখনো বক্সিং বিষয়ে খুব বেশি ধারণা ছিল না। অভিজ্ঞতা বলতে মাসখানেকের কারাতের শিক্ষা। ট্রায়ালে টিকে গেলেন তিনি। ২০০৭ সালে ভর্তি হলেন বিকেএসপিতে। খেলাটাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতেই কেটে যায় প্রথম দুই বছর।
জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুবাদে ২০১৪ সালে গ্লাসগোতে কমনওয়েলথ গেমসে লড়ার সুযোগ হলো। তবে সেখানে পয়েন্ট ব্যবধানে হেরে যান। ২০১৫ সালে ট্যালেন্ট হান্ট করতে বাংলাদেশে আসেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বক্সার আলী। সুর কৃষ্ণ তখন বিকেএসপির পাট চুকিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই ট্যালেন্ট হান্ট লন্ডনে বক্সিং শেখার সুযোগ করে দিল। ছয় মাস সেখানে বিশ্বখ্যাত পেশাদার বক্সারদের কাছে বক্সিং শিখলেন। দেশে ফিরে আবার ভারতে যান। সেখানে পেশাদার বক্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নেন, একই সঙ্গে দুটি ম্যাচ খেলেও জেতেন। তারপর অপেশাদার বক্সিং থেকে দেশ-বিদেশের আরও কিছু পদক জেতেন। তবে পুরোদস্তুর পেশাদার বক্সিং খেলতে চাইছিলেন সুর কৃষ্ণ চাকমা। গত বছর প্রথমবার দেশে অনুষ্ঠিত হয় পেশাদার বক্সিং ইভেন্ট ‘সাউথ এশিয়ান প্রো বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ’, সেখানে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হন সুর। চলতি বছর মার্চে থাইল্যান্ডের এক বক্সারকে হারান। এখন শুধু পেশাদার বক্সিংই খেলতে চান সুর।
নিজের র্যাংক অনুসারে এখন অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন টাইটেলে লড়তে পারবেন। তবে ধাপে ধাপে নিজের উন্নতি করে এগিয়ে যেতে চান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের দিকে। সুর কৃষ্ণ চাকমা বলেন, ‘জানি, এটা কঠিন। তারপরও বক্সিংকেই যেহেতু পেশাদার খেলা হিসেবে নিচ্ছি, তাই ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে চাই। সেভাবেই নিজেকে তৈরি করতে হবে।’
প্রতিটি খেলার আগেই নানা ধরনের ফিটনেস পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যান একজন বক্সার। বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ গেমসেই যেমন মেডিকেল চেকআপে উচ্চ রক্তচাপের কারণে বাদ পড়ে যান সুর কৃষ্ণ চাকমা। সেবার ২৪ ঘণ্টার টানা ভ্রমণ ও দেশের পতাকা নিয়ে মার্চপোস্টে অংশ নিয়ে রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল। সুর কৃষ্ণ বলেন, ‘প্রতিবার বক্সিং রিংয়ে নামার আগে এমআরআই করতে হয়। মানসিকভাবে ফিট থাকতে হয়। তবে খেলার আগে অনেক ধরনের কঠিন প্রশিক্ষণ নিতে হয় বলে খেলার দিনটা খুব শক্ত কিছু মনে হয় না।’
খেলার আগে কেমন থাকে সুরের দৈনন্দিন জীবনযাপন? খাবার, ব্যায়াম বা মানসিক সুস্থতার বিষয়গুলো সামলান কীভাবে, জানতে চাইলে এই পেশাদার বক্সার জানান, প্রতিটি খেলার আগেই তো অনেক পরিশ্রম যায়, তাই খেলার পর সপ্তাহ দুই বিশ্রাম নিই। তবে খেলার আগে রুটিন মেনে চলার চেষ্টা করি।
সেই সময়ে ডায়নামিক নানা রকম ট্রেনিং চলে, শিখতে হয় বিভিন্ন কৌশল, নিতে হয় রাশিয়ান স্টাইলের নানা রকম প্রশিক্ষণ। বক্সিংয়ে দম একটা বড় ব্যাপার, সেই সঙ্গে জরুরি মাথা ঠান্ডা রাখা। তাই কার্ডিও করতে হয় নিয়মিত। একই সঙ্গে ধ্যান। নিয়মিত ধ্যানচর্চা করেন সুর, নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন পর্যাপ্ত ঘুম। বিখ্যাত বক্সারদের কাউন্সেলিং সেশন থাকে আলাদা। সেটা অনেক ব্যয়বহুল, তাই এখনো নিজের জন্য তেমন সেশন রাখতে পারেননি সুর।
অনেকে মনে করেন, জিম মানেই মাসল বাড়ানো। কিন্তু বক্সারদের কাছে জিম হলো শক্তি ও সামর্থ্য বাড়ানোর জায়গা। সেটাই করেন সুর।
অন্য সময়ে সাধারণ খাবার খেলেও খেলার আগে চার্ট মেনে খান সুর, ‘এই সময় তেল-মসলা বাদ দিয়ে খানিকটা সেদ্ধ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করি।’ সকালে উঠে ছোলা, বাদাম বা কিশমিশ খেয়ে ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দৌড়ানোর চেষ্টা করেন। সেই সঙ্গে কিছুক্ষণ শ্যাডো করেন। কার্ডিও শেষ করে ফ্রেশ হয়ে সকাল ১০টার আগেই সকালের নাশতা করেন। মেন্যুতে থাকে দুটি সেদ্ধ বা পোচড ডিম, ব্রেড, মধু, কলা, দুধ, সালাদ, ফ্রেশ ফলের জুস ইত্যাদি। খাবারের পর একটা বিরতি নিয়ে কমপক্ষে এক ঘণ্টা ঘুম। এরপর বেলা একটার মধ্যে লাঞ্চ। সেখানে থাকে অল্প ভাত আর নানা রকম মাছ, মাংস, সবজি। বিকেলে কোচদের সঙ্গে নানা রকম বক্সিংয়ের কৌশল নিয়ে কাজ করেন কয়েক ঘণ্টা। সন্ধ্যার আগে দুধ, ফল বা রুটি-জাতীয় কিছু খান। রাতে ভাতের সঙ্গে মুরগি বা মাছ। শেষপাতে থাকে মিষ্টি। কারণ, বক্সারদের চিনি দরকার হয়, যেহেতু তারা অনেক বার্ন করেন। প্রচুর পানি ও তরল খাওয়ার চেষ্টা করেন সুর। স্ত্রী তিসি চাকমার প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ সুর। কারণ, সুর যখন ট্রেনিং নিয়ে ব্যস্ত, তখন তাঁর খাবার থেকে শুরু করে নানা রকম আনুষঙ্গিক বিষয়ে খেয়াল রাখেন স্ত্রী।
বিশ্বজুড়ে পেশাদার বক্সাররা লাখ লাখ টাকা আয় করেন। বাংলাদেশে ধারণাটা নতুন হলেও সুরের হাত ধরে যাত্রাটা শুরু হলো। এরই মধ্যে সুরের সঙ্গে নানা রকম চুক্তি করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিকাশ, গ্লোবাল ব্র্যান্ড বাটা ও ফ্যাশন ব্র্যান্ড তুরাগ। তাই আর্থিকভাবেও নতুন বক্সারদের একধরনের উদাহরণ তৈরি করলেন সুর কৃষ্ণ।