প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।
আমাদের সময় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছোট ওয়ান, বড় ওয়ানের পর ছিল দ্বিতীয় শ্রেণি। বড় ওয়ান থেকে সবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছি। বিদ্যালয়ে বই বিতরণ হচ্ছে কিন্তু আমাকে বই দেওয়া হচ্ছে না। কারণ, ফির ১০ টাকা বাকি পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে এসে মাকে বললাম। মা মাথায় ঘোমটা দিয়ে আমার হাত ধরে স্কুলে নিয়ে চললেন। মায়ের আঁচলে বাঁধা একটা ১০ টাকার নোট। টাকাটা মা কোথায় পেয়েছিলেন, আজও আমার কাছে সেটা এক রহস্য।
লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি মা। কিন্তু লেখাপড়ার গুরুত্বটা ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন। শত অভাব–অনটনের মধ্যেও আমাদের তাই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিতেন। রাজমিস্ত্রির জোগালি করে সামান্যই উপার্জন করতেন আমার আব্বা। বাড়িতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পুষতেন মা। এতে করে সংসারের দৈনন্দিন খরচ আর আমাদের তিন ভাইয়ের পড়াশোনার খরচটা জোগাড় হয়ে যেত। গরুর দুধ বিক্রি করলেও মা ছাগলের দুধ বিক্রি করতেন না। ছাগলের দুধটুকু রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমাদের তিন ভাইকে খেতে দিতেন। মনে পড়ে না মাকে কখনো দুধ খেতে দেখেছি। তিনি নাকি ছাগলের দুধে গন্ধ পান। নিজে ছাগলের দুধে গন্ধ পান কিন্তু সেই দুধ জ্বাল দিয়ে সন্তানকে খেতে দেন।
রাত জেগে পড়াশোনা করতে হয় মাঝেমধ্যে। রাত জাগতে গেলেই আমার একটা সমস্যা হতো। মাথাটা কেমন জানি শূন্য শূন্য লাগত। হয়তোবা খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভোগা শরীর এই রাতজাগাটা নিতে পারত না। তখন মা আমার মাথাটাকে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে হাতের তালুতে নারিকেল তেল নিয়ে আমার চাঁদিতে দিয়ে দিতেন। এভাবে কয়েকবার দেওয়ার পর পানি নিয়ে একইভাবে সেখানে দিয়ে দিতেন। এরপর আমি আবার পড়া শুরু করতাম। আমার খুবই অবাক লাগে আমার মা মাথা ঘোরা থামানোর এই টোটকাটা কোথায় পেয়েছিলেন।
মাধ্যমিকের নিবন্ধন চলছে কিন্তু তখনো আমার ফি জোগাড় হয়নি। জানিও না কীভাবে জোগাড় হবে। বাড়ি ফিরে মাকে বললাম। শুনে মা মুচকি হাসলেন আর বললেন, ‘যার কেউ নেই, তার আল্লাহ আছেন।’ নির্দিষ্ট দিনে আমাদের পোষা ছাগলটার একমাত্র বাচ্চা খাসি ছাগলটার দড়ি আমার হাতে দিয়ে মা বললেন, ‘ওকে নিয়ে যাও। ওর দাম থেকে স্যারদের ফিস নিয়ে নিতে বলো।’ আমার মেজ ভাইও একই স্কুলে পড়ত। আমি ছাগলের দড়ি ধরে সামনে আর ও পেছন থেকে খেদিয়ে নিয়ে চললাম। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে মা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকলেন। আমরা জানি, বাড়ির প্রতিটা গৃহপালিত প্রাণী ছিল আমাদের পরিবারের সদস্য তুল্য। ছাগলের বাচ্চা হলে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সেটা মার সঙ্গে ঘুমাত। আর এই বাচ্চাটা ছিল মায়ের বিশেষ আদরের।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তির সুযোগ পেয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো বাড়ির বাইরে যাচ্ছি। ঢাকা শহরে রক্তের সম্পর্কের আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই যে বিপদে–আপদে এগিয়ে আসবে। আমি হয়তোবা কিঞ্চিৎ ভয়ই পেয়েছিলাম। চরভবানীপুরের বাড়ি থেকে বের হয়ে রিকশায় করে বাসস্ট্যান্ডে যেতে হয়। মোড়ে রিকশায় ওঠার মুহূর্তে আবারও মা আমাকে তাঁর সেই সাহস জোগানো কথাটা বললেন, ‘যার কেউ নেই, তার আল্লাহ আছেন।’
কথাটা ঢাকা শহরে আমার জীবনটা সহজ করে দিয়েছিল।