কেমন চলছে এবারের ভর্তি প্রস্তুতি

দুই ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থী নাবিলা ও রায়তা
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ফার্মগেট মেট্রো স্টেশন থেকে নেমেই একধাক্কায় যেন ফিরে গেলাম বছর কয়েক পেছনে। ইন্দিরা রোডের এই জায়গা আমার খুব চেনা। শরতের তপ্ত বিকেলে বহু শিক্ষার্থীকে ব্যাগ কাঁধে ছুটতে দেখা গেল। এই ভিড়ে তো একদিন আমিও ছিলাম। এই শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। শেষ বিকেলের কমলা আলোয় তাঁদের কারও কারও মুখে তারুণ্যের দীপ্তি, কারও মুখে ক্লান্তির ছায়া চোখে পড়ল। কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করব বলে পা বাড়াই।

এবার যাঁরা ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন, প্রায় সবাই ২০২৪ সালের এইচএসসি ব্যাচ (আগের ব্যাচেরও অনেকে আছেন, যাঁরা দ্বিতীয়বার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন)। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষার মাঝপথেই শুরু হয় ‘জুলাই বিপ্লব’, থেমে যায় পরীক্ষা। আন্দোলন শেষেও পূর্বাঞ্চলে ছিল বন্যার ভয়াবহতা। নানা কারণে পরীক্ষা বা পড়ালেখা—কোনোটিতেই মন দেওয়ার সুযোগ হয়নি অনেকের।

পড়ালেখায় ফেরা

ভর্তিযুদ্ধে নামার আগে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থেকে রাজধানীর ফার্মগেটে এসেছেন রেজওয়ানা আফরীন। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরীক্ষাপদ্ধতি বা প্রশ্নকাঠামো নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তায় ভুগছেন কি না, জানতে চাইলাম তাঁর কাছে। বললেন, ‘পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে ঠিক; কিন্তু এতে মোটাদাগে পরীক্ষাপদ্ধতি বা প্রশ্নকাঠামোয় পরিবর্তন আসবে কি না, সেসব নিয়ে ভাবছি না। এমন কিছুর সম্ভাবনা কমই মনে হচ্ছে। তবে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সাধারণ জ্ঞান অংশের ইতিহাসনির্ভর প্রশ্নগুলোয় হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আসবে।’

দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন মো. তাজকাতুল ইমরান। ফার্মগেট মেট্রো স্টেশনে তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো। পরীক্ষাপদ্ধতি বা প্রশ্নকাঠামো নিয়ে চিন্তিত নন তিনিও। বললেন, ‘এবারের পরীক্ষা শেষ না হওয়ার প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। এইচএসসির জন্য আমাদের তো পূর্ণ প্রস্তুতিই ছিল; সেহেতু পরীক্ষাপদ্ধতি বা প্রশ্নকাঠামো নিয়ে চিন্তার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।’ তবে অন্য চ্যালেঞ্জের কথাও বললেন এই শিক্ষার্থী, ‘জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে পড়াশোনা একপ্রকার থেমেই গিয়েছিল। এরপর মাঝের সময়টাতে আমি পড়ার টেবিল থেকে দূরে ছিলাম। এখন আগের মতো পড়ায় মন বসাতে একটু সমস্যা তো হচ্ছেই।’

গত কয়েক মাসে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। মাস দুয়েক আগে তাঁরা যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছিলেন, এখনো কি পরিকল্পনা একই আছে?

ইমরানের মতোই ‘পড়ার টেবিল থেকে দূরে’ ছিলেন ঢাকার নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী অলিন্দ আল কাভী। কুষ্টিয়ার এই তরুণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘তখন (আন্দোলনের সময়টায়) আমাদের চিন্তাটা শুধু দেশ নিয়েই ছিল। কখন, কোথায় কী হচ্ছে, সে খবর নিয়েই পড়ে থাকতাম। প্রায় দেড় মাসের একটা বিরতি পড়ে গেছে।’ এখন নতুন উদ্যমে পড়ায় মন দিতে চেষ্টা করছেন অলিন্দ।

গত কয়েক মাসে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে বড় ধরনের ঝড় বয়ে গেছে। মাস দুয়েক আগে তাঁরা যে পরিকল্পনায় এগোচ্ছিলেন, এখনো কি পরিকল্পনা একই আছে? জানার আগ্রহ ছিল। মেহেরপুর থেকে মেয়েকে নিয়ে ফার্মগেটের একটি কোচিংয়ে ভর্তি করাতে এসেছেন মো. মোখলেছুর রহমান। তিনি বললেন, ‘আমি যদ্দুর জানি, সে ভার্সিটির খ ইউনিটের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখনো তা-ই নিচ্ছে।’ চাঁদপুরের রেজওয়ানা, দিনাজপুরের ইমরান, কুষ্টিয়ার অলিন্দও একই কথা বললেন। তাঁদের লক্ষ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

আগে কোচিংয়ের জন্য ঢাকামুখী হওয়ার চলই বেশি ছিল। মূলত করোনা–পরবর্তী সময়ে এ পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন ঢাকার বাইরে থেকে কিংবা অনলাইনের মাধ্যমেও ভালো প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ আছে। ঝিনাইদহের ছেলে মাহমুদুল হাসান যেমন এখন খুলনায় আছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্য। হোয়াটসঅ্যাপে আলাপ হলো তাঁর সঙ্গে। বললেন, ‘বোর্ড পরীক্ষা শর্ট সিলেবাসে হয়েছে। তাই এবারের ভর্তি পরীক্ষাগুলোয় শর্ট নাকি ফুল সিলেবাস থেকে প্রশ্ন হবে, তা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা আছে।’

প্রশ্নপত্রেও জুলাই বিপ্লব

সাধারণ জ্ঞান অংশের ইতিহাসনির্ভর প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নতুনভাবে প্রস্তুতি করছে কোচিং সেন্টারগুলো। মেডিকেল কোচিং করায়—ঢাকার এমন একটি কোচিং সেন্টারের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপ হলো। তাঁরা তাঁদের প্রকাশিত সহায়িকার (গাইড বইয়ের) পাঠ্যসূচিতে এবারের জুলাই বিপ্লবকে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জানালেন।

পরীক্ষাপদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে কি না, জানতে যোগাযোগ করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম খাদেমুল হকের সঙ্গে। গত কয়েক বছর ভর্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। বললেন, ‘এর আগে কয়েকবার ভর্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তবে গত বছর থেকে সেই দায়িত্বে নেই। এবার খুব বড় কোনো পরিবর্তন আসবে বলে আমি মনে করি না। কেননা, পদ্ধতিগত কোনো পরিবর্তন এলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা বছরখানেক আগেই জানিয়ে দেয়। যেমনটা ঘটেছিল ২০২৩ সালে ঘ ইউনিট তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে। ২০২২ সালেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ঘ ইউনিট পরের বছর থেকে থাকছে না। এবার এখন পর্যন্ত বড় কোনো পরিবর্তনের নির্দেশনা আসেনি।’

পরিস্থিতি ভিন্ন। তাই শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি একটু ভিন্নভাবে নিতে পরামর্শ দিলেন ২০২১-২২ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অর্জনকারী অনন্য গাঙ্গুলী। তিনি বলেন, ‘এবারের ভর্তি পরীক্ষা একটি অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে হতে যাচ্ছে। চলমান রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব যেমন মনের ওপর পড়েছে, তেমনি প্রশ্নেও আমরা নিশ্চয়ই কিছু পরিবর্তনের ছাপ দেখতে পাব। বিগত সরকারের আমলের বিভিন্ন অর্জন এবং তাদের দলীয় ইতিহাসের ওপর তুলনামূলক কম গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সংবিধান, ভৌগোলিক অবস্থান—এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। সেই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য ও তাঁদের কার্যক্রমও সাম্প্রতিক বিষয়াবলি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোও ভালোভাবে জেনে রাখতে হবে।’

পড়াশোনার সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া ‘দূরত্ব’ কাটিয়ে কীভাবে শিক্ষার্থীরা মনোযোগী হতে পারেন, সেই পরামর্শও দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষার্থী। ‘ভর্তি প্রস্তুতিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কম সময় দিয়ে বইয়ের পড়ায় বেশি সময় দিতে হবে। বেশি বেশি মডেল টেস্ট দিতে হবে। প্রশ্নকাঠামোর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে প্রস্তুতি নিলে ভালো ফল করা সম্ভব।’