ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ২০০৯ সালে এফসিপিএস করলেন এ বিষয়ে। ২০১৭ সালে তিনি জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেলেন। এখনো এখানেই একটি ইউনিট–প্রধান হিসেবে আছেন
‘২০০১ সালে যখন হৃদ্রোগ বিষয়ে ডিপ্লোমা কোর্স করতে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছিলাম, তখন কোর্সে নারী ট্রেইনি ছিলেন মাত্র দুজন। আমি আর ডাক্তার দূর্বা হালদার। ওয়ার্ড বা ক্লাস থেকে শুরু করে ক্যাথ ল্যাব—চারদিকে সবাই ছিলেন পুরুষ। এমনকি ক্যাথ ল্যাবে নারীদের পোশাক পরিবর্তনের জন্য আলাদা একটি চেঞ্জিং রুমও ছিল না। অথচ এখন দিন পাল্টে গেছে। কার্ডিওলজি কোর্সে বর্তমানে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক। ক্যাথ ল্যাব থেকে ওটি—সব জায়গাতেই পুরুষদের পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন নারীরা,’ বলছিলেন জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডাক্তার সাবিনা হাশেম।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নারীদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশে এখন সত্যিই বেশ আশাব্যঞ্জক। হৃদ্রোগ বিষয়েও তা–ই। ডাক্তার সাবিনা হাশেমই বললেন, ‘আপনারা জানলে অবাক হবেন যে বাংলাদেশে প্রথম ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজি বা পিসিআই (পারকিউটেনিয়াস করোনারি ইন্টারভেনশন) শুরু করেছিলেন একজন নারী, অধ্যাপক ডাক্তার সুফিয়া রহমান। আগে এখানে কেবল এনজিওগ্রাম হতো, কোনো ইন্টারভেনশন, মানে স্টেন্টিং ইত্যাদি হতো না। সুফিয়া ম্যাডাম বিলেত থেকে এমআরসিপি করে এসে বাংলাদেশে ইন্টারভেনশন কার্ডিওলজির সূচনা করেন। তাঁর পরই অধ্যাপক হাসিনা বানু, ডাক্তার ফাতেমা মুনমুনদের মতো স্বনামধন্য কার্ডিওলজিস্টের আবির্ভাব। আর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ফজিলাতুন্নেসা মালিক তো কেবল দেশেই নয়, আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত একজন ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট। এ দেশে সব ধরনের জটিল ইন্টারভেনশনগুলো তিনিই মূলত করেছেন। এ বিষয়ের একজন এক্সপার্ট হিসেবে সারা পৃথিবীতে তাঁকে সবাই চেনে। সুতরাং সংখ্যায় পুরুষদের চেয়ে কম হলেও এ দেশে হৃদ্রোগ বিষয়ে নারী বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি ও অবদান উজ্জ্বল। বর্তমানে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের তিনটি ইউনিট–প্রধানের দায়িত্বে আছেন তিনজন নারী।’
অধ্যাপক সাবিনা হাশেম ঢাকার আজিমপুরের অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তাঁর মা ছিলেন অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়েরই শিক্ষক, কানিজ হাশেম। বাবা আবুল হাশেম ছিলেন অডিটর জেনারেল। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ইন্টার্ন করার সময় কার্ডিওলজি ইউনিটের প্রশিক্ষণে এ বিষয়ের প্রতি তাঁর প্রথম আগ্রহ জন্মায়। ১৯৯৫ সালের তাঁর বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। চিকিৎসকেরা জানান যে তাঁর হার্টের রক্তনালিতে যে ব্লক আছে, তার জন্য করোনারি বাইপাসই সবচেয়ে আদর্শ চিকিৎসা। তখনো বাংলাদেশে বাইপাস সার্জারি শুরু হয়নি। চিকিৎসার জন্য তাঁকে তাই ভারতে যেতে হয়েছিল। সেখানে প্রখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট ডা. দেবী শেঠির কাছে চিকিৎসা নেন তিনি। কন্যা সাবিনাও গিয়েছিলেন সঙ্গে। সেখানে গিয়েই তিনি সংকল্পবদ্ধ হন যে হৃদ্রোগ বিষয়েই পড়বেন। ২০০১ সালে যোগ দেন ডিপ্লোমা কোর্সে। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটেই। সেখানে তখন কাজের প্রচণ্ড চাপ, এদিকে সন্তানের মা হয়েছেন; সব দিক সামলাতে গিয়ে অস্থির হয়ে ভেবেছিলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর পড়াশোনা করব না!’ কিন্তু সহকর্মী পুরুষ চিকিৎসকেরা যখন একে একে উচ্চতর প্রশিক্ষণ আর ডিগ্রি নিতে চলে যেতে থাকলেন, ‘ভাবলেন মেয়ে বলে পিছিয়ে থাকব?’ ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রশিক্ষণ নিলেন। ২০০৯ সালে এফসিপিএস করলেন এ বিষয়ে। ২০১৭ সালে তিনি জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেলেন। এখনো এখানেই একটি ইউনিট–প্রধান হিসেবে আছেন।
‘কেবল পড়াশোনা বা ডিগ্রি করলেই হয় না, একজন নারীকে তাঁর যোগ্যতা বা স্কিলের বারবার প্রমাণ দিতে হয়। পুরুষদের থেকে এটাই পার্থক্য আমাদের। যতক্ষণ না প্রমাণ করছেন যে আপনি পুরুষদের মতোই দক্ষ, ততক্ষণ আস্থা অর্জন করা কঠিন। রোগী, সাধারণ মানুষ, এমনকি চিকিৎসকমহলেও একসময় এমন ধারণা বিরাজ করত, “ডিগ্রি থাকলেও উনি তো একজন মহিলা, ইন্টারভেনশনের মতো জটিল কঠিন কাজ ওনাকে দিয়ে হবে তো?” কার্ডিওলজি তো জটিল বিষয়, আছে হাতের সূক্ষ্ম কাজ—এনজিওগ্রাম, রিং পরানো বা স্টেন্টিং, পেসমেকার বসানো, ভাল্ভ প্রতিস্থাপন। এ ধরনের বিষয়ে নারী চিকিৎসকের ওপর আস্থা স্থাপনে অনেক সময়ই সমস্যা হয় বৈকি। এমনও হয়েছে, আমি আমার ইউনিট নিয়ে রাউন্ডে গেছি, রোগী বা তাঁর স্বজন তখন আমার জুনিয়র যে পুরুষ চিকিৎসক, তাঁর দিকে তাকিয়ে, তাঁকেই মূল চিকিৎসক ভেবে কথা বলছেন, সমাধান বা সিদ্ধান্ত চাইছেন। তখন আমাকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলতে হয়েছে যে আমিই আপনার মূল চিকিৎসক, আপনি আমার আন্ডারেই ভর্তি আছেন, আর আমিই আপনার প্রসিডিউর করব,’ বলতে বলতে হাসলেন ডাক্তার সাবিনা। এ–ও বললেন, ‘এখন আর সেই দিন নেই। কম মানুষই এখন নারী–পুরুষ বাছবিচার করেন। বরং কে ভালো চিকিৎসক, কে মন দিয়ে সময় নিয়ে রোগী দেখেন, কার হাত ভালো—এসব খবর আগে নেন রোগীরা। উপকার পেয়ে সম্মান করেন, অন্যদেরও রিকমেন্ড করেন। এই পরিবর্তন এক দিনে হয়নি। শত শত নারী চিকিৎসক নানা বিষয়ে দক্ষতা আর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন বলেই সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও জটিল আর সূক্ষ্ম নতুন নতুন বিষয়েও আমরা নারীদের আধিপত্য দেখতে পাব।’