প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসাবে কাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে পাঠকের কাছে লেখা চেয়েছিল ‘ছুটির দিনে’। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন অনেক পাঠক। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।
ছোটবেলায় বাবাকে খয়েরি রঙের একটা ঝরনা কলম ব্যবহার করতে দেখতাম। সেটার নাম ছিল লিলি কলম।
সেটা ১৯৮৪ কি ৮৫ সালের কথা। আমি সবে পেনসিল ছেড়ে কলম ধরেছি। ইয়ুথ নামের ঝরনা কলমে লিখি। একদিন বাড়িতে খয়েরি রঙের লিলি কলমটার পাশে আরেকটা সবুজ রঙের একই ধরনের কলম দেখি। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ওটা স্কুলের কলম। ভুল করে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। আমার বাবা ছিলেন প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক।
পরদিন দেখি কলমটা আর নেই। বাবা স্কুলে ফেরত দিয়ে এসেছেন। সবুজ কলমটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। কলমটার কথা ভুলতেই পারছিলাম না। কিন্তু একটা কলম থাকতে আরেকটার আবদার করার সাহসও তখন ছিল না।
বেশ কিছুদিন পরের কথা। স্কুলের কাজে খুলনা যাবেন বাবা। আমাদের বাড়ি থেকে খুলনায় যেতে হতো তখন লঞ্চে করে। সময় লাগত সাত-আট ঘণ্টা। খুব ভোরে উঠতে হতো। রাতেই ব্যাগপত্র, জামাকাপড় গুছিয়ে রেখেছেন বাবা। আমার হঠাৎ সেই সবুজ রঙের লিলি কলমের কথা মনে পড়ল। মাথায় একটা বুদ্ধিও এল। ছোট কাগজে লিখলাম, ‘বাবা, আমার জন্য একটা সবুজ রঙের লিলি কলম নিয়ে আসবা।’ তারপর সেটাকে কয়েক ভাঁজ করে বাবার পাঞ্জাবির ডান পাশের সাইড পকেটে রেখে দিলাম। বুক পকেটে রাখলাম না এই ভয়ে যে যদি পাঞ্জাবি পরতে গিয়ে পড়ে যায়! আবার বাম পাশের সাইড পকেটে রাখিনি, কারণ, বাবা ডান পাশের সাইড পকেটই বেশি ব্যবহার করেন।
পরের দিন সকালে আমি ওঠার আগেই বাবা খুলনায় রওনা হয়ে গেলেন। আমি শুধু ভাবছি, আমার লেখাটা কি বাবার চোখে পড়ল! বাবা কি আমার জন্য কলমটা কিনবেন, নাকি ভুলে যাবেন। লেখাটা হারিয়ে যায়নি তো! অপ্রয়োজনীয় কাগজ ভেবে না দেখেই বাবা ফেলে দিলেন না তো! এসব ভাবতে ভাবতে দুই দিন গেল।
নির্দিষ্ট দিনে সন্ধ্যার পরে বাবা ফিরলেন। বাবার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঘরে তুলে রাখলাম। বাবা পাঞ্জাবিটা খুলে মার কাছে দিলেন। ছাতা আর জুতা জোড়া তুলে রাখলেন বারান্দায়। পুকুর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বসেছেন। আমি ঘরে বাবার পাঞ্জাবির পকেট চেক করছি।
না, পকেটে সেই চিরকুটটা নেই। তাহলে লেখাটা নিশ্চয়ই বাবার হাতে পড়েছিল। কিন্তু কলমটা কি এনেছেন! এখনো কিছু বলছেন না কেন?
ধৈর্য হারিয়ে বাবার ব্যাগ খুলে খুঁজতে শুরু করে দিলাম।
এমন সময় বারান্দা থেকে বাবার ডাক, ‘শরদিন্দু, ঘর থেকে আমার ব্যাগটা আনো তো, বাবা।’
তাড়াতাড়ি ব্যাগের চেইন আটকে বাবার কাছে নিয়ে গেলাম। বাবার জন্য তখন এক গ্লাস শরবত বানিয়ে এনেছে মা। বাবাকে ব্যাগ দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। উৎকণ্ঠা কাটছে না। বাবা কাছে ডাকলেন। পাশে বসালেন। তারপর বললেন, ‘সবুজ রঙের লিলি কলম লাগবে?’
আমি একটু লজ্জা পেলাম। শুধু মাথা নাড়লাম। বাবা ব্যাগ থেকে একটা নতুন সবুজ রঙের লিলি কলমের বাক্স বের করলেন। এগিয়ে দিলেন আমার দিকে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘হারিয়ো না যেন।’
আমি মাথা নেড়ে কলমের বাক্সটা নিয়ে ঘরে গেলাম। একবার পেছন ফিরে দেখলাম, হাসতে হাসতে বাবা যেন মাকে কিছু একটা বলছেন।