করোনাকাল তখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভান্ডারবিল্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন নারায়ণগঞ্জের ছেলে সাজ্জাদ ইসলাম। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর ভিসা হলো না। কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না সাজ্জাদ। মন খারাপ করে ঘুরে বেড়ান। বন্ধুদের একদল বুয়েট বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু করে দিয়েছে। আরেক দল বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে।
বন্ধু শিহাব সারার আহমেদও তখন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যাওয়ার আগে তিনি তাঁর ওয়ার্ল্ড রোবট অলিম্পিয়াডের (ডব্লিউআরও) সরঞ্জাম সাজ্জাদকে দিয়ে যান। বলেন, এটার পেছনে লেগে থাকলে হয়তো সময়টা ভালো কাটবে। এক মাস পর শিহাবই তাঁকে জানান, ডব্লিউআরওর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ পর্বের আয়োজক বাংলাদেশ ওপেনসোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন)।
সাজ্জাদের ভাষ্য, ‘আমি তখন ভাবছি—এত কম সময় আর সামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা কি উচিত হবে? শিহাব আমাকে সাহস দিল। বলল, শেখার সবচেয়ে ভালো উপায়গুলোর একটি হলো কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। আমি ফিউচার ইঞ্জিনিয়ার্স ক্যাটাগরিতে নিবন্ধন করতে গেলাম। গিয়ে জানলাম, দল হতে হয় দুজনের। আমার তো কেউ নেই।’
সে সময়ই নটর ডেমের তৌসিফ সামিনের সঙ্গে পরিচয়। দুজন মিলে নিবন্ধন করলেন। করোনার কারণে বাংলাদেশ পর্বের প্রতিযোগিতা সেবার অনলাইনে হয়েছিল। অনারেবল মেনশন পেয়ে ডব্লিউআরওতে অংশগ্রহণের মনোনয়ন পেয়ে যায় সাজ্জাদ-সামিনের দল। শুরু হয় বিশ্বমঞ্চের জন্য প্রস্তুতি। সাজ্জাদ বলছিলেন, ‘সে সময় প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা যাওয়া-আসা করতাম। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিধিনিষেধ ছিল। এ পরিস্থিতিতেই বিডিওএসএনের (মাহেরুল আযম) কোরেশী ভাইয়ের কাছ থেকে কাজের নির্দেশনা, উপকরণ সংগ্রহ করতাম এবং নিজেরা প্রস্তুতি নিতাম। যখন যা লাগত, তাঁরা ব্যবস্থা করে দিতেন।’
করোনার জন্য ডব্লিউআরও সেবার অনলাইনে হয়েছিল। সেটা ছিল ডব্লিউআরওতে বাংলাদেশের প্রথম অংশগ্রহণ। প্রথমবারেই সাজ্জাদ ও সামিনের দল টিম প্রোডিজি সারা পৃথিবীর মধ্যে দশম স্থান অর্জন করে।
পরের সেশনে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যান সাজ্জাদ। এখন স্ট্যানফোর্ডের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন তিনি। বলছিলেন, ‘আমি আমার অ্যাডমিশন ফাইলটা দেখেছি। ডব্লিউআরও ঘিরে আমার প্রস্তুতি, নিজেকে তৈরি করা—সবই ভর্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মতো ছোট্ট একটা শহর থেকে উঠে আসা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত মা-বাবার সন্তান হিসেবে আমার সর্বতো চেষ্টাকে অ্যাডমিশন অফিস গুরুত্ব দিয়েছে।’
ডব্লিউআরওতে সাফল্যের পর দেশে এর আয়োজক প্রতিষ্ঠান বিডিওএসএনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান সাজ্জাদ। ২০২২ সালে তৌসিফ সামিন ও ইকবাল সামিনের দল টিম লেইজি গোর কোচের দায়িত্ব নেন সাজ্জাদ। সেবার জার্মানির ডর্টমুন্ড শহরে অনুষ্ঠিত ডব্লিউআরওর ১৯তম আসরে দলটি তাক লাগিয়ে দেয়। তৃতীয় হয়ে ব্রোঞ্জপদক অর্জন করে। রোবট বানানোর জন্য তারা ব্যবহার করেছিল দেশে নকশা করা ও উন্নয়নকৃত জেআরসি বোর্ড।
পরের বছর ডব্লিউআরও বাংলাদেশের জাতীয় পর্বের বিচারক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাজ্জাদ। আন্তর্জাতিক পর্বেও বিচারক হিসেবে তাঁর নাম প্রস্তাব করে বিডিওএসএন। সাক্ষাৎকার শেষে তাঁকেই নির্বাচিত করে ডব্লিউআরও কর্তৃপক্ষ।
পানামায় জুরি সদস্যদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে কম বয়সী। এটি একই সঙ্গে ভয়ের ও আনন্দের। অন্য বিচারকদের বেশির ভাগই অভিজ্ঞ। তাঁদের সাহচর্যে শিখেছি অনেক কিছু। বিচার করার সময় প্রতিযোগীদের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দেখে মনে পড়ত, নারায়ণগঞ্জে নিজের বাড়িতে বসে কীভাবে প্রস্তুতি নিতাম।সাজ্জাদ ইসলাম
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে পানামায় অনুষ্ঠিত ২০তম ডব্লিউআরওতে আন্তর্জাতিক বিচারক হিসেবে যোগ দেন সাজ্জাদ ইসলাম। রোবট অলিম্পিয়াডে প্রতিযোগী হিসেবে অংশগ্রহণের তিন বছরের মাথায় আন্তর্জাতিক পর্বের বিচারক, অন্তত বাংলাদেশ থেকে এমন নজির আর নেই। সাজ্জাদ বলেন, ‘পানামায় জুরি সদস্যদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে কম বয়সী। এটি একই সঙ্গে ভয়ের ও আনন্দের। অন্য বিচারকদের বেশির ভাগই অভিজ্ঞ। তাঁদের সাহচর্যে শিখেছি অনেক কিছু। বিচার করার সময় প্রতিযোগীদের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি দেখে মনে পড়ত, নারায়ণগঞ্জে নিজের বাড়িতে বসে কীভাবে প্রস্তুতি নিতাম।’
সাজ্জাদ এখন বিশ্বের সেরা গবেষকদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। মেশিন লার্নিং, ডিপ লানিং, অটোনোমাস সিস্টেম, ইমিটেশন লার্নিং ইত্যাদি তাঁর কাজ ও পড়ার ক্ষেত্র।
দেশের জন্য কিছু করতে চান এই তরুণ। ২০২৩ সালে দেশে ডব্লিউআরও আয়োজনের জন্য নিজের ফেলোশিপ থেকে আর্থিক সাহায্য করেছেন। এখন রোবোটিকস, কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার মতো বিষয়গুলোয় শিশু-কিশোরদের অনুপ্রাণিত করতে চেষ্টা করছেন তিনি।