বোনের দানে বাঁচল ভাইয়ের জীবন

ডোনার হিসেবে বোন লিভার দিয়ে বাঁচাল বড় ভাইয়ের জীবন
ছবি : লেখকের সৌজন্যে

৬ জানুয়ারি ২০১৬। আমি তখন সময় টেলিভিশনে কাজ করি। সকালেও বিজনেস বুলেটিন পড়েছি। কিন্তু বিকেলের পর হঠাৎ বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়ি। অচেতন অবস্থায় আমাকে চারতলা থেকে ধরাধরি করে নামিয়ে নিকটবর্তী গ্যাস্ট্রোলিভার (পরে বিআরবি) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

আমি তখন ব্যাচেলর। অফিসের কয়েকজন সহকর্মী মিলে একটা ফ্ল্যাটে থাকি। আমি হেপাটাইটিস বি পজিটিভ, এই তথ্য আমার বাগ্‌দত্তা রিমু জানত। লিভার চিকিৎসার জন্য বিআরবি হাসপাতাল উপযুক্ত হবে, এই বিবেচনায় রিমুই সিদ্ধান্ত নিয়ে ওখানে ভর্তি করায়। সন্ধ্যার পর হাসপাতালে সময় টেলিভিশনের সহকর্মীরা ভিড় করে। তখনো আমি অচেতন। এইচডিইউতে আমাকে বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ডাক্তাররা নাকি বলেছিলেন, বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা ৩০ ভাগ।

জটিল অস্ত্রোপচার শেষে ভাই বেঁচে ফিরবে কি না, তা নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা তবে বোনের সাহসের কোনো কমতি ছিল না

মধ্যরাতে জ্ঞান ফেরে। পা দুটি বেডের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করি। হাতে স্যালাইনের মাধ্যমে চলছে নানা রকম ওষুধের প্রয়োগ। সেখানেই ছিলাম দুদিন। কেবিনে শিফট করার পর আরও তিন দিন ছিলাম। সে যাত্রায় বেঁচে যাই। তবে ডাক্তাররা বললেন, লিভার অকেজো হয়ে গেছে। হেপাটিক সিরোসিস। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার একমাত্র উপায় লিভার প্রতিস্থাপন। আমার মামাতো ভাই ডাক্তার প্রণব সাহা চিকিৎসার বিষয়ে সব দেখভাল করছিল। মেডিকেল কলেজে ওর এক বড় ভাই ছাত্রজীবনে আমার মতো রোগে আক্রান্ত হয়। লিভার প্রতিস্থাপন করে সে এখন ভালো আছে। ওর মুখেই এসব শুনি। বলে, প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। বয়স বিবেচনায় বাবা-মায়ের লিভার দেওয়ার সুযোগ নেই। ছোট বোন অর্চনার বয়স সবে ১৮ বছর। ও-ই আমাকে লিভার দান করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ অ্যাপোলো হাসপাতালে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে খরচের হিসাব পাওয়া যায়। ৪৫ লাখ টাকার মতো লাগবে। অল্প সময়ে এত টাকার ব্যবস্থা করা খুব কঠিন। তবে আমার সহকর্মীরা সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়াল। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও তাদের সিএসআর তহবিল থেকে অর্থসহায়তা করে। বাকিটা পরিবারই জোগাড় করে। কয়েক লাখ টাকার বিদেশি মুদ্রা নিয়ে মার্চের শেষ দিকে আমি, বাবা ও অর্চনা দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা করি। দিল্লিতে এই আমার প্রথম আসা। পরিচিত কেউ নেই। কপালগুণে বিমানবন্দরে দেশের এক ছোট ভাই হরষিতকে পেয়ে যাই। ওখানেই প্রথম দেখা। ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দর থেকে সে আমাদের অ্যাপোলো হাসপাতালের কাছাকাছি একটা গেস্টহাউস ঠিক করে দিল।

ডোনেট করার বছরখানেকের মধ্যে অর্চনার লিভার আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে

পরদিনই হাসপাতালে বিখ্যাত লিভার সার্জন সুভাষ গুপ্তার চেম্বারে হাজির হই। শুরু হয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ডোনার বোনের বেশ কিছু মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়। সর্বশেষ ডা. গুপ্তা সিদ্ধান্ত দেন, ডোনার হিসেবে বোন উপযুক্ত। ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যাবে। কোনো রকম ভয়ভীতি বা পরিবারের চাপে পড়ে ডোনেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না, নিশ্চিত হওয়ার জন্য এরপর বোনের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলে মেডিকেল বোর্ড। অঙ্গ প্রতিস্থাপন করার অনুমোদন নিতে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনেও যাই আমরা। জমা দিতে হয় বিস্তর কাগজপত্র। যাহোক, সিদ্ধান্ত হলো এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সার্জারি হবে।

তখনো পুরো টাকা আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। নানা রকম ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে সহকর্মী রুপল টাকা পাঠাতে সক্ষম হয়। সময় লাগে ৩ দিন। পুরো সময় অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠায় পার করি। সাড়ে ১৯ লাখ রুপি জমা দিয়ে ২৫ এপ্রিল আমি আর অর্চনা হাসপাতালে ভর্তি হই। এটা শুধু সার্জারি ও পরবর্তী ২১ দিনের হাসপাতাল খরচ।

পরদিন সকালে আমাদের গোসল করতে বলা হয়। অপারেশন-পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ গোসল করা যাবে না। গোসল শেষে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার মুখে দুই ভাই-বোনের দেখা। এমন জটিল অস্ত্রোপচার শেষে বেঁচে ফিরব কি না, আমার চোখেমুখে সেই অনিশ্চয়তা। তবে বোনের সাহসের কমতি ছিল না। পাশাপাশি দুই থিয়েটারে অপারেশন। লিভার প্রতিস্থাপনে ২০ থেকে ২১ ঘণ্টা সময় লাগে।

পুরো ফ্রেমে স্ত্রী, কন্যা ও বোনসহ হরি সাহা

পরদিন দুপুরে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো আইসিইউতে নিজেকে আবিষ্কার করি। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম মেডিকেল ডিভাইস। চোখ মেলে তাকানো ছাড়া নড়াচড়ার আর কোনো শক্তি নেই। বিকেলে বাবা বাইরের মনিটর দিয়ে দেখে যান। আইসিইউতে তৃতীয় দিন নার্সদের কাছে জানতে চাই, বোন কেমন আছে? তাঁরা জানান, সে ভালো আছে, কোনো সমস্যা নেই।

৮ দিন পর আমাকে কেবিনে নেওয়া হয়। এরই মধ্যে একটু একটু হাঁটতে শুরু করেছি। একদিন পাশের লবিতে গিয়ে বোনের সঙ্গে দেখা করি। ১৪ দিন পর ওকে ছুটি দেয়। ডাক্তারকে বলে আমার কেবিনে ওকে অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে রাখি, যাতে কোনো সমস্যায় ডাক্তারের সেবা পায়। ১৮ দিন পর আমাকেও ছুটি দেওয়া হয়। এ সময় প্রতিদিন কয়েকবার করে আমার রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রেসহ নানা পর্যবেক্ষণ চলে। বয়স কম হওয়ায় আমার দ্রুত উন্নতি হয়। নির্ধারিত সময়ের আগে ছাড়া পাই। অনেকে মাসখানেকও থাকেন।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও সপ্তাহে দুই-তিন দিন পরীক্ষার জন্য যেতে হতো। এভাবে এক মাস পর দেশে আসার ছাড়পত্র পাই। তবে মাসে দুইবার লিভার, কিডনি ফাংশন, সিবিসিসহ বেশ কিছু টেস্টের রিপোর্ট পাঠাতে হতো মেইল করে। ১৫ রকমের ওষুধ চলে ৬ মাস।

লিভার প্রতিস্থাপনের পর সাংবাদিক হরি সাহা এখন স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন

চিকিৎসার এই দীর্ঘযাত্রা শেষে ৭ বছর পার করেছি। অপারেশনের সাত মাস পর রিমুকে বিয়ে করি। দেড় বছর পর কন্যাসন্তানের বাবা হই। ওই বছরই ডিসেম্বর থেকে অফিস শুরু করি। এখন ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে কাজ করছি। অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক সাংবাদিকতা এবং সংবাদ উপস্থাপনা করি। তবে প্রতি তিন মাস পরপর নির্ধারিত কিছু মেডিকেল টেস্ট করতে হয়। নিয়মিত কিছু ওষুধও খেতে হয়। তারপরও দুরারোগ্য লিভার সিরোসিস জয় করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা আমার কাছে এখনো বিস্ময়কর। লিভার ডোনারের এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো ঝুঁকি নেই বলে জানান চিকিৎসকেরা। আমার বোন ইংরেজিতে স্নাতক শেষ করে এখন একটি চাকরি করছে। বছরখানেকের মধ্যে তার লিভার আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। প্রতিস্থাপনে ৪০ থেকে ৫০ ভাগ লিভার দান করতে হয়। বছরখানেকের মধ্যে এটা সাধারণত আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

একসময় এই অঞ্চলে লিভার সিরোসিসের কোনো উন্নত চিকিৎসা ছিল না। গত শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতে লিভার প্রতিস্থাপন শুরু হয়। এখন দেশেও লিভার প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চলছে। বিএসএমএমইউতে দু-একটা করাও হয়েছে। ভারতের চেন্নাই, দিল্লির কয়েকটি হাসপাতালে ব্যয়বহুল এ সার্জারি করা হয়। তবে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের চেয়ে তা সস্তা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতে এ ধরনের চিকিৎসা নিতে আসেন অনেক রোগী। লিভার প্রতিস্থাপনে সুস্থ জীবনে ফেরা বাংলাদেশির সংখ্যা আনুমানিক দেড় শ জন।

যত দূর জেনেছি, তিনটি কারণে লিভার অকেজো হতে পারে। একটি হেপাটিক (হেপাটাইটিস বি, সি থেকে), অ্যালকোহলিক (অতিরিক্ত মদ্যপানে), আরেকটি ফ্যাটি লিভার থেকে। বাসার বাইরে বারবার ব্যবহৃতর হয়, এমন পাত্রে চা ও খাবার খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। এর মাধ্যমে হেপাটাইটিস ছড়াতে পারে দেহে। সুরক্ষা হিসেবে পরিবারের সবার উচিত হেপাটাইটিস বি-এর টিকা নেওয়া। মানবদেহের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গের যত্ন নিতে খাদ্যাভ্যাস হতে হবে স্বাস্থ্যকর। রেড মিট ( গরু-খাসি) কম খাওয়া, শাকসবজি, ফলমূল বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। পাশাপাশি যাঁরা হেপাটাইটিসে আক্রান্ত, তাঁদের নিয়মিত ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকা উচিত।