পড়াশোনায় খুব একটা মন দিতে না পেরে ২০০৮ সালে বরিশাল থেকে ঢাকায় আসেন হোসেন খান। নাটক–সিনেমার শুটিং দেখতে গিয়ে শখ জাগে মেকআপ আর্টিস্ট হওয়ার। কাজ শুরু করেন সহকারী হিসেবে। এখন তিনি দেশের অন্যতম ব্যস্ত এক মেকআপ আর্টিস্ট। তারকাদের সাজ থেকে শুরু করে সাধারণ বিয়ের কনেরাও অনেকে সাজতে চান হোসেন খানের কাছে
তাঁর শিডিউল নিতে তারকারাই স্বয়ং ফোন করেন। কনের সাজ থেকে পার্টি মেকআপ—সবখানেই থাকা চাই হোসেন খানের হাতের ছোঁয়া। দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের তারকা ব্যক্তিদের মেকআপ তো করেনই, সাধারণ বিয়ের কনেও সাজান হোসেন খান। অথচ নিজে কখনো ভাবেননি ঢাকায় এসে মেকআপ আর্টিস্ট হবেন। কীভাবে মিলল সেই সুযোগ? হোসেন খান বলেন, ‘সোহাগ নামের আমার এক কাজিন নাটকে মেকআপের কাজ করতেন। সহকারী হিসেবে একদিন তাঁর সঙ্গে পুবাইলে গেলাম শুটিং দেখতে। নিজের শেখার আগ্রহ জন্মাল। এর মধ্যে একদিন মনির ভাই (মনির হোসেন, ফ্যাশন ও ব্রাইডাল মেকআপ আর্টিস্ট) আমার কাজিনকে ফোন করে জরুরিভাবে একজন সহকারী চাইলেন। ভাই আমাকে পাঠালেন। মনির ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, শেখার অনেক সুযোগ আছে।’
নাটক–সিনেমার মেকআপের ধরন এক রকম আর ফ্যাশন বা চলতি ধারার মেকআপ আরেক রকম। প্রথমটিতে একই লুক চলতে থাকে সিনেমাজুড়ে। তবে ফ্যাশন মেকআপে নিয়মিত লুক পরিবর্তন করতে হয়। তাই শেখার সুযোগ মেলে বেশি। এসব বুঝেই হোসেন খান মেকআপ আর্টিস্ট মনির হোসেনকে অনুরোধ করেন তাঁকে কাজ শেখানোর। তিন বছর মনিরের কাছে কাজ শেখেন হাতে–কলমে। এই সময়ে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের ফটোশুট, ম্যাগাজিনের ফটোশুটে মেকআপের জন্য মনিরের সঙ্গে যেতে থাকেন হোসেন। পাশাপাশি নিজেও নানাভাবে হাত পাকানোর চেস্টা করেন। ইন্টারনেটে টিউটোরিয়াল দেখে, পরিচিতদের বউ সাজিয়ে দক্ষতা বাড়াতে থাকেন। এভাবেই একদিন জনপ্রিয় ফ্যাশন আলোকচিত্রী রফিকুল ইসলামের (র্যাফ) নামে পরিচিত) ফোন আসে মনির হোসেনের কাছে। একটা ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ মডেলদের সাজাতে হবে। কিন্তু আগে থেকে আরেকজন নায়কের শিডিউল থাকায় ম্যাগাজিনের কাজটিতে মনির পাঠান হোসেনকে। অনেক ভয়ে ভয়ে হোসেন সেই ফটোশুটে যান। ফটোশুটের জন্য যাঁদের সাজাতে হবে, সবাই তখন বড় মডেল। ফটোশুটটি যিনি কোরিওগ্রাফি করছেন (মাহমুদুল হাসান মুকুল), তিনিও পরিচিত মুখ। হোসেন খান বলেন, ‘সব বড় মানুষের সঙ্গে আমি একমাত্র আনাড়ি। তবে লেআউটগুলো হাতে পেয়ে সাজানোয় মনোযোগ দিলাম। ছবি তুলতে গিয়ে র্যাফ ভাই বললেন “ভালো সাজাইছো।” পরদিন আরেকটি শুটের মেকআপ করার প্রস্তাব দিলেন র্যাফ ভাই। সেটি ছিল এখনকার জনপ্রিয় পারলার অরা বিউটি লাউঞ্জের প্রচারণার ফটোশুট। এই ফটোশুটই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।’
অরা বিউটি লাউঞ্জের উদ্যোক্তা মাহদিন তারেক ও নিশাত আদনান তারেক উপস্থিত ছিলেন সেই ফটোশুটে। অরার বেশ কয়েকজন সৌন্দর্যকর্মীর সঙ্গে মেকআপে আমিও ছিলাম। এরপর একদিন রফিকুল ইসলামের মাধ্যমে হোসেনের কাছে প্রস্তাব এল অরাতে চাকরি নেওয়ার। তত দিনে এই অলোকচিত্রীর মাধ্যমে দেশসেরা অনেক তারকাকে সাজিয়ে ফেলেছেন হোসেন খান। তাই চাকরির প্রস্তাবটা তিনি লুফে নিলেন।
অরা বিউটি লাউঞ্জের মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে প্রতিদিন একাধিক বউ সাজাতে শুরু করলেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন ফ্যাশন ফটোশুটের মডেলদের সাজানো ছাড়াও তারকাদের ব্যক্তিগত সাজেও ফোন আসতে শুরু করল হোসেনের কাছে। জয়া আহসান থেকে শুরু করে সাকিব আল হাসান, সাফা কবির, বাঁধন, মম, আরিফিন শুভ, সিয়াম, বিদ্যা সিনহা মিম, বুবলী, নুসরাত ফারিয়া, তানজিন তিশা, কনা, টয়া, শবনম ফারিয়া, মেহজাবীন—কে নেই সেই তালিকায়! একই সঙ্গে প্রথম আলোর নকশা, ‘আইস টুডে’র মতো ম্যাগাজিনের অসংখ্য ফটোশুটে মডেলদের সাজান হোসেন।
২০২২ সালে অরার চাকরিটা ছেড়ে দেন হোসেন। কারণ, এই সময়ে এতই বাইরের কাজ আসতে থাকে যে চাকরি সামলে সেগুলো করা কঠিন হয়ে পড়ে। তারকাদের সাজানো ছাড়াও সাধারণ অনেক নারীকে কনের সাজে সাজাচ্ছেন হোসেন। এ পর্যন্ত কতগুলো বউ সাজিয়েছেন, জানতে চাইলে হাসলেন। বললেন, ‘এ কী গুনে রাখা সম্ভব! এক মিম আপুকে (অভিনেত্রী) কতবার বউ সাজিয়েছি, সেটাই তো বলা কঠিন! ফটোশুটের বউ ছাড়াও বিয়ের দিন আমার হাতেই কনে সেজেছিলেন তিনি। জয়া আহসান আপুর মতো তারকা যখন বলেন, “এই শুটের মেকআপে আমার হোসেনকেই লাগবে।” তখন মনে সাহস পাই। হয়তো এখন কিছুটা হলেও শিখতে পেরেছি।’
বরিশালের বাকেরগঞ্জের ছেলে হোসেন খানেরা তিন ভাই–বোন। হোসেন বিয়ে করেছেন ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জে। আড্ডাচ্ছলে জানতে চাইলাম, আপনার হাতের মেকআপ নিশ্চয়ই আপনার স্ত্রীও খুব পছন্দ করেন। হোসেন খান দিলেন এক মজার উত্তর, ‘না, না। বউ আমার মেকআপ পছন্দ করে না। একবার দাওয়াতে যাওয়ার আগে তাকে পার্টি মেকআপ করে দিলাম, একটু পর সে সব তুলে নিজের মতো করে সাজলো। ও খুব একটা মেকআপ পছন্দ করে না।’
লেখাটি বর্ণিল বিয়ে ২০২৪ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত