রাসায়নিক উপাদানে যেসব পণ্য তৈরি হয়, তার ফলাফল হয়তো দ্রুত মেলে, কিন্তু ক্ষতি হয় অনেক বেশি। অপর দিকে প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি এসব পণ্যের সুফল পেতে যদিও সময় কিছুটা বেশি লাগে, তবে ফল হয় ইতিবাচক এবং দীর্ঘস্থায়ী।
প্রাকৃতিক পণ্যের ওপর দিন দিন মানুষের আস্থা বাড়ছে। ইকো ফ্রেন্ডলি লাইফস্টাইল বা প্রকৃতিবান্ধব জীবনযাপনের প্রতি আগ্রহই মানুষকে এই ধরনের পণ্য ব্যবহারে উৎসাহী করে তুলছে। গাছপালা আর প্রাণীজ উৎস থেকে তৈরি এসব পণ্যের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। রাসায়নিক উপাদানে যেসব পণ্য তৈরি হয়, তার ফলাফল হয়তো দ্রুত মেলে, কিন্তু ক্ষতি হয় অনেক বেশি। অপর দিকে প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি এসব পণ্যের সুফল পেতে যদিও সময় কিছুটা বেশি লাগে, তবে ফল হয় ইতিবাচক এবং দীর্ঘস্থায়ী।
আয়ুর্বেদ, ভেষজ বা অরগানিক—এই তিন পদ্ধতিরই মূল বিষয় কিন্তু এক। সব কটিই প্রকৃতি থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে। তবে এসব শব্দ কার্যকারিতা অনুযায়ী আলাদা অর্থ বহন করে। আয়ুর্বেদীয় রূপচর্চার সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের অনেক দিন ধরেই পরিচয়। সঙ্গে যোগ হয়েছে ভেষজ ও অরগানিক পদ্ধতি। অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে, তিনটিতে তো প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার থাকে, তাহলে তিনটার পার্থক্য কোথায়? এই প্রসঙ্গে আয়ুর্বেদিক রূপবিশেষজ্ঞ রাহিমা সুলতানা বলেন, আয়ুর্বেদের ‘আয়ু’ শব্দের অর্থ ‘জীবন’, ‘বেদ’ অর্থ ‘জ্ঞান’। সুস্থ, নীরোগ, দীর্ঘ জীবনযাপনের জন্য যে বিজ্ঞান, সেটিকে বলে আয়ুর্বেদ। প্রাকৃতিক ভেষজ ছাল, বীজ, বাকল, লতা, পাতা, শিকড় থেকে নির্যাস নিয়ে আয়ুর্বেদিক পণ্য তৈরি করা হয়। ত্বক ও চুলের সমস্যা বুঝে সমাধান দেওয়া হয়। শুধু প্রাকৃতিক পণ্যের ব্যবহারই নয়, আয়ুর্বেদ হলো জীবনযাপনের একটি পদ্ধতি। যেখানে শুধু চুল ও ত্বকের চর্চাতেই নয়, খাবারদাবারেও ভেষজ উপকরণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এদিকে যেসব খাদ্য উপাদান ও হার্বস কোনো রকম রাসায়নিক সার, অ্যান্টিবায়োটিক, হরমোন বা কীটনাশক ছাড়া উৎপাদিত হয়, সেগুলোকে বলে অরগানিক পণ্য। অরগানিক হলো রাসায়নিক ছাড়া খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া। হারবাল শব্দটির অর্থ ‘ভেষজ’। এই পদ্ধতিতে গাছের লতা, পাতা, ছাল, শিকড়, বিভিন্ন ধরনের গাছের কষ ও বীজ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়।
এই ধরনের প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি পণ্য নিয়ে এখন বাণিজ্যিকভাবে কাজ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। রিবানা, মিনা হারবাল, আড়ং আর্থ, নিওফারমার্স বা শস্য প্রবর্তনার পণ্যগুলো এখন ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয়। রিবানার উদ্যোক্তা মো. ওয়াহিদুজ্জামান পেশায় একজন ফার্মাসিস্ট। পড়াশোনা করার সময় ল্যাবে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন, এসব উপকরণ তৈরিতে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, ত্বক ও চুলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তখন থেকেই তিনি অরগানিক পণ্য তৈরির উদ্যোগ নেন। প্রথমে স্বল্প পরিসরে নারকেল তেল, ক্যাস্টর অয়েল ও কাঠবাদামের তেল নিয়ে কাজ শুরু করে রিবানা। ক্রেতাদের কাছে ভালো সাড়া পাওয়ায় ত্বক ও চুলের জন্য ২০টির মতো পণ্য বাজারে আনে তারা। এর মধ্যে আছে অ্যালোভেরা জেল, স্যাফরন ব্রাইটেনিং জেল, চন্দন কাঠের ফেইস প্যাক, গোলাপজল এবং নানা ধরনের সাবান। ‘স্যাফরন গোটস মিল্ক’ ছাগলের দুধ থেকে তৈরি সাবানটি দিয়ে সবচেয়ে বেশি সাড়া পান তাঁরা।
গাজীপুরে নিজেদের রিসোর্ট বেজক্যাম্পে রান্নার উপকরণ নিয়ে কাজ করার সময় এর উদ্যোক্তা তামজীদ সিদ্দীক দেখলেন, প্রায় সব খাবারের উপকরণে প্রচুর কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার হচ্ছে। মানুষ যাতে ভেজালমুক্ত খাবার খেতে পারে, এই ভাবনা থেকেই রিসোর্টেই তারা অরগানিক পদ্ধতিতে শাকসবজির চাষবাস শুরু করেন। এ ছাড়া তামজীদ সিদ্দীক তার পরিবারের সদস্যদের জন্য রিসোর্টেই শুরু করেন ঘি আর মধু উৎপাদন। রিসোর্টেই আগত অতিথিদের কাছ থেকে অরগানিক পণ্যে নিয়ে ব্যাপক সাড়া পান। তখন থেকে তাঁরা বাণিজ্যিকভাবেই এই ধরনের পণ্য তৈরির সিদ্ধান্ত নেন, বলছিলেন নিওফারমার্সের হেড আব অপারেশনস আকাশ চৌধুরী। শুধু নারকেল, কাঠবাদাম বা ক্যাস্টর তেলই নয়, পেঁয়াজের তেল, শজনে পাতার ফেসপ্যাক বা কুমড়া বীজের তেলও যে রূপচর্চায় ব্যবহার হতে পারে, তা বিভিন্ন গবেষণা করে বের করে নিওফারমার্স। অনেকেরই অজানা যে কুমড়া বীজের তেল মাথার তালুর ময়লা দূর করে ত্বক পরিষ্কার করে। সপ্তাহে দুই দিন এটি চুলের ত্বকে লাগালেই মিলবে দারুণ ফল। শজনে পাতার গুঁড়া ত্বকের কালো কালো ছোপ দূর করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন কারণে ত্বকে যে দাগ পড়ে, তা-ও শজনের প্যাক ব্যবহার করলে দূর হয়।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ সম্প্রতি বাজারে এনেছে অরগানিক পণ্য। মায়া নামের এই উদ্যোগে এখন পাওয়া যাচ্ছে মায়া অল ন্যাচারাল স্ক্যাল্প অ্যান্ড হেয়ার অয়েল এবং ট্রু হার্বস মেরুলা অয়েল। স্কয়ার টয়লেট্রিজের জ্যেষ্ঠ মার্কেটিং ম্যানেজার ফজলে মাহমুদ বলছিলেন, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার যে উপকারিতা, এখন তা মানুষ বুঝতে পেরেছে, তাই তারা অরগানিক পণ্যের প্রতি ঝুঁকছে। ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখেই স্কয়ার এই তেল দুটি এনেছে। এই পণ্য চুল পরা বন্ধ করবে, লম্বা করবে এবং ভাঙা রোধ করবে। এ ছাড়া নতুন চুল গজানোসহ আরও নানা উপকারিতা রয়েছে এই তেলে। এদিকে মেরুলা অয়েল প্রতিদিন কয়েক ফোঁটা ব্যবহার করলে মুখের ত্বকের কালো দাগ ও বলিরেখা দূর হবে। চাইলে চুলেও এই তেল ব্যবহার করতে পারেন। এতে চুল হবে কোমল ও মসৃণ।
চুল সুস্থ রাখতে প্রাকৃতিক নারকেল তেলের বিকল্প কমই আছে। পাশাপাশি নতুন চুল গজাতে ব্যবহার করতে পারেন ক্যাস্টর অয়েল। পেঁয়াজের তেল একই কাজ করবে। নিমের তেল ত্বকের ছত্রাক দূর করে। ত্বকের দাগ দূর করে চন্দন কাঠের গুঁড়া। অ্যালোভেরার গুণের তো শেষ নেই, তেমনি আছে মেহেদি পাতার গুণাগুণ। রূপচর্চায় প্রাচীনকাল থেকেই আছে হলুদের ব্যবহার। আর এমনই নানা প্রাকৃতিক উপকরণ এখন বোতলজাত মোড়কে খুব সহজেই মিলবে আপনার হাতের কাছে। আর সুস্থ ও রোগমুক্ত থাকার জন্য এসব পণ্য ব্যবহারের সত্যিই কোনো বিকল্প নেই।