জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘সিন্ডিকেট’ দেখেছেন?
উত্তর যদি হয় ‘হ্যাঁ’, তাহলে নিশ্চয়ই মনে আছে, সেখানে আদনান (আফরান নিশো) কীভাবে জিশাকে (নাজিফা তুষি) নিজের ভালোবাসার কথা জানান। আদনান জিশার দিকে তাকিয়ে দুহাত ধরে বলেন সাদাত হোসাইনের কবিতার লাইন, ‘শোনো কাজল চোখের মেয়ে আমার দিবস কাটে, বিবশ হয়ে তোমার চোখে চেয়ে।’
নব্বইয়ের দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলোর ভেতর ১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ সিনেমায় ব্যবহৃত অ্যান্ড্রু কিশোরের ‘পড়ে না চোখের পলক’ অন্যতম। বড় পর্দায় রিয়াজ তাঁর প্রেমিকার মন জয় করতে ঠোঁট মিলিয়ে গেয়ে ওঠেন, ‘কাজল কালো, ওই দুটি চোখ, ও চোখে জাদু আছে।’ এরও বহু আগে ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘ওগো ও কাজল-মেয়ে, উদাস আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে।’
কবিতা থেকে গান হয়ে সিনেমা, ওয়েব সিরিজ—সবখানে কেন কাজলের প্রসঙ্গ? কেন প্রেয়সীর কাজলকালো ছলছল চোখে হাবুডুবু খায় প্রেমিক? যুগ যুগ ধরেই বাঙালি নারীর সাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে কাজল। সময়ের সঙ্গে সেই কাজলের রূপ বদলেছে। বিভিন্ন রঙের কাজল, স্মোকি, গ্রাফিক্যাল একেক সময় একেক ধারা চলতি। তবে আইলাইনার থেকে গ্লিটার—সবই হার মেনেছে চিরায়ত কাজলের কাছে!
সুতি কাপড়ের লম্বা ছোট একটা টুকরো পেঁচিয়ে সেটা ঘিয়ে ভেজানো হয়। বের হয়ে থাকা অংশে জ্বালানো হয় আগুন। তারপর একটা ধাতুর (সাধারণত তামা) পাত্র রশ্মির ওপর ধরে কালি জমানো হয়। সেই কালির ওপর সামান্য পরিমাণে তেল (কর্পূর, শর্ষে বা নারকেল তেল) আর চন্দন মেশানো হয়। তেল, চন্দনের সঙ্গে কালি মিশে তৈরি হয় চমৎকার সুরমা-কাজল। এরপর একটা কাপড়ের টুকরো ভাঁজ করে চিকন করে অথবা তুলা পেঁচিয়ে (কটনবাডের মতো করে) সেই কাজল ব্যবহার করা হতো চোখে। এ অঞ্চলের নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার মধ্যেই কাজল ব্যবহারের চল ছিল। কেননা এই সুরমা চোখের চারপাশে (ওপরে ও নিচের অংশে) দেওয়ার ফলে চোখের আশপাশের অঞ্চল ঠান্ডা রাখত। ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে প্রচণ্ড গরমে এটি ছিল একটি জনপ্রিয় প্রসাধনী।
‘নজরটিকা’ হিসেবেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় কাজল। ধারণা করা হয়, কপালের কালো কাজল শিশুকে সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। এখনো এ অঞ্চলের নারীরা তাঁদের সন্তানকে ‘খারাপ নজর’ থেকে রক্ষা করার জন্য ভরসা রাখেন কাজলের টিপের ওপর। এখন তো বাজারে চুড়ি-ফিতার দোকানে গিয়ে বললেই হয়। বাচ্চাদের টিপ দেওয়ার জন্য পাওয়া যায় আলাদা কাজল। সেটা শিশুর কপালের যেকোনো এক পাশে বড় গোল করে লাগিয়ে এর ওপর সামান্য পাউডার দিয়ে দেওয়া হয়, যাতে কাজলের কালি ছড়িয়ে না পড়ে আর কাজলটাও হয় দীর্ঘস্থায়ী। সাধারণত শিশুকে গোসলের পর ওভাবে কাজল দেওয়া হয়। এ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়ার সময়ও শিশুকে ভালো পোশাকের সঙ্গে কাজল পরাতে ভোলেন না মায়েরা।
১৯৩০-এর দশক থেকে ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত কাজল নিয়ে নানা নিরীক্ষা হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে প্রথমবারের মতো মেকআপ বিশ্বে আলোড়ন ফেলে ‘স্মোকি আই’। এর আগেও ভিন্নভাবে ছিল এই পদ্ধতি। তখন নারীরা আগের রাতে কাজল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। সারা রাত কাজল ‘স্ক্যাটার্ড’ হয়ে সুন্দর করে ছড়িয়ে পড়ত চোখের ওপরে আর নিচের অংশে। পরদিন সেই কাজলের সাজ অক্ষুণ্ন রেখে নারী যেতেন অনুষ্ঠানে বা প্রিয়জনের কাছে। বিয়ের আগের রাতেও এভাবে মোটা করে কাজল পরার চল ছিল, যাতে বিয়ের দিন সুন্দর দেখায় চোখ। তখন যদিও এটাকে ‘স্মোকি আই’ ডাকা হতো না।
চোখের ওপরের পাতায় ছড়িয়ে কালো কাজল দেওয়ার প্রথাটা সামান্য ভোল বদলে এখনো প্রাসঙ্গিক। সেখান থেকেই এসেছে আইশ্যাডোর ব্যবহার। ষাটের দশকে জনপ্রিয়তা পায় ড্রামাটিক ক্যাট আই। নব্বইয়ের দশকে কেবল ওপরে কাজল দেওয়া পায় জনপ্রিয়তা। এখন ‘সিম্পল লাইনার’সহ সব রকমভাবেই কাজল দেওয়ার চল রয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে পশ্চিমা নারীর বিউটি বক্সেও ঢুকে পড়েছে বাঙালি নারীর নিজস্ব সজ্জার এই উপকরণ।
ভারতে যে কালার কসমেটিকের (কাজল, লিপস্টিক, লিপগ্লস, আইশ্যাডো ইত্যাদি) মার্কেট, এর ২৫ শতাংশ কাজলের। ভারতের অনেক নারী এটাকে কসমেটিক হিসেবে দেখতেই রাজি নন। তাঁরা কাজলকে ফেলেছেন মৌলিক চাহিদা আর কসমেটিকের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে। ‘ভোগ ইন্ডিয়া’র প্রতিবেদন অনুসারে, মাত্র কয়েক বছরের কাজলের ইন্ডাস্ট্রি ফুলেফেঁপে উঠেছে। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে গড়ে প্রতিবছর ২৯ শতাংশ করে বেড়েছে এই ইন্ডাস্ট্রি। ২০১০ সালে ভারতে কাজল ছিল মাত্র ২৫০ কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি। ২০১৫ সালে তা প্রায় ৯০০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছায়। আর এখন কাজল ভারতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ইন্ডাস্ট্রি। নাইকা ব্র্যান্ডের সিইও ফাল্গুনী নায়ার জানান, তাঁদের বেস্টসেলিং আইটেমগুলোর ভেতর একেবারে শীর্ষে কাজলের অবস্থান। আর যত ধরনের কাজলজাতীয় পণ্য আছে, এর ভেতর ৮০ শতাংশের বেশি বিক্রি হয় আইলাইনার ও কাজল পেনসিল।
বাংলাদেশে কাজলের ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কোনো সমীক্ষা নেই। তবে বাংলাদেশের মেয়েদের বিউটি পার্সে যদি একটা উপকরণ থাকে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা কাজল। যাঁরা মেকআপ করেন না, একেবারেই সাধারণভাবে থাকেন, তাঁদের অনেকেই সাজ বলতে বোঝেন চোখে কাজল আর কপাল ছোট্ট একটা কালো টিপ। ব্যস, অনুষ্ঠান বা দাওয়াতের জন্য তৈরি।
বলিউড তারকা দীপিকা পাড়ুকোন ও সোনম কাপুরের মেকআপ আর্টিস্ট নম্রতা সোনি বলেন, ‘কাজল ছাড়া কোনো নারী ঘর থেকে বের হয়? আমি সে রকম কাউকে চিনি না। কাজল ভালোবাসে না, এ রকম নারী হয় না। হতে পারে না। আমি প্রতিদিন কাজল দিই। দীপিকা বা সোনম, কেউ-ই কাজল ছাড়া পারতপক্ষে ঘরের বাইরে পা রাখেন না।’ নম্রতা জানান, তিনি ক্রিমজাতীয় কাজল বেশি পছন্দ করেন। কেননা এটা দিতেও সুবিধা, আবার চোখগুলো দেখতেও সুন্দর লাগে। আরেক বলিউড তারকা কারিনা কাপুর ভোগ ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘কাজল না দিয়ে আমি কোথাও যাই না। আমার চোখগুলোকে কাজল দেওয়া অবস্থায় দেখতে বেশি ভালোবাসি। কাজলকে মনে হয় আমার চোখেরই একটা অংশ। আমার মনে হয়, আমি আরও বেশি আবেদনময়ী।’
বিশ্বব্যাপী কোভিড পরিস্থিতিতেও এই কাজল দেওয়া নিয়ে হয়েছে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অনেকেরই ঘরে প্রসাধন পণ্য নিয়ে সৃজনশীল সময় কাটানোর জন্য কাজলের চেয়ে ভালো প্রসাধন পণ্য হাতের কাছে পাননি।
নারী দিবসে বা নানা উপলক্ষে প্রিয় নারীকে কী উপহার দেবেন ভাবছেন? উত্তরটা কিন্তু খুবই সহজ!