বাংলায় প্রবাদ—কানু বিনে গীত নাই। সেই কানুকে আশ্রয় করে পৌরাণিক চরিত্র হয়ে ওঠা ফুলটির নাম কদম। বৃষ্টি ঝরুক আর না ঝরুক, কদম ফুটলেই বর্ষা নামে বাংলায়। ঘন কালো মেঘ চুইয়ে নেমে আসা অবিরাম জলধারায় জবুথবু দাঁড়িয়ে থাকা কদম বর্ষার সৌন্দর্যের অন্য নাম। মেঘের সঙ্গে মিতালি বলেই হয়তো এর আরেক নাম মেঘাগমপ্রিয়। আর নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা হয় বলে হয়তো এর আর একটা নাম ললনাপ্রিয়।
কিন্তু কী আশ্চর্য, অত্যন্ত মৃদু, প্রায় নেই বললেই চলে এমন সুগন্ধের জন্যও কদমকে ডাকা হয় সুরভি নামে! বৃত্তপুষ্প, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবল্লভ, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, সর্ষপ, প্রাবৃষ্য, সিন্ধুপুষ্প নামেও কদমের পরিচিতি আছে সংস্কৃত ভাষায়। ‘এসো নীপ বনে নবধারাজলে’ লিখে রবীন্দ্রনাথ কদমকে বাঙালি মননে স্থায়ী করে দিয়েছেন বর্ষার ফুল হিসেবে। কিন্তু তারও আগে মধ্যযুগের বৈষ্ণব কবিরা কদমগাছকে আরাধ্য কানুর লীলা খেলার জায়গা হিসেবে অধিকার করে নিয়েছিলেন, তমালকে সঙ্গে রেখে। তমাল আর কদম এই দুই গাছকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বৈষ্ণব সাহিত্যের মানসলোকের বিহার। বাংলা লোকসংগীতে সে ধারা অব্যাহত আছে এখনো।
বৈষ্ণব পদকর্তাদের মানসলোকে যেমন, তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন পর্যায়ে কদমের গুরুত্ব তৈরি হয়েছে শত শত বছরের চর্চায়।
কদমতলায় বসে কদমছাঁটের কথা কে না জানেন? মাথার মাঝখানে কিছুটা বড় রেখে চারদিকের চুল একেবারে ছোট করে কাটার পুরোনো যে স্টাইল চিনি আমরা, সেটাই কদমছাঁট। সাধারণত সেনাবাহিনীর জওয়ানেরা এভাবে চুল কাটেন বলে এটি আর্মি ছাঁট নামে পরিচিত হয়ে গেছে। অনেকে আবার একে সেভ কাটও বলে থাকেন।
যে যা–ই বলুন না কেন, আমরা এটাকে কদমছাঁট নামেই চিনি। গত শতকের আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে আমাদের জোর করে, প্রায় ঘাড়ে ধরে বসিয়ে দেওয়া হতো ক্ষৌরকারের সামনে। সাধের চুলে কদমছাঁট দেওয়া হবে ভেবে আমরা কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে যেতাম। তাতে অবশ্য কোনো লাভ হতো না। বহু ব্যবহারে জীর্ণ গলায় জড়ানো লালসালুতে ধাতব কাঁচির কচকচ শব্দে কাটতে থাকা চুল জমতে থাকত আর আমরা অক্ষম জেদে প্রতিজ্ঞা করতে থাকতাম, বড় হলে রাহুল কাট দেব, দেখিস! অবশ্য বড় হয়ে দেখেছি, ঘুরেফিরে সেই কদমছাঁটেরই বিভিন্ন সংস্করণ সময় সময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
কদমপুর হয় না অবশ্য, হয় কদমতলা কিংবা কদমতলী। পুর অর্থে নগর। সেই নগরের যে অংশে কদমগাছের সংখ্যা বেশি সে অংশের নাম কদমতলী। তবে নগরের কদমতলীর সঙ্গে কদমতলী গ্রামের চিত্রকল্পের ফারাক বিস্তর। নগরের কদমতলীতে কদমগাছ স্মৃতিময় অতীত হলেও কদমতলী গ্রামে এখনো মেঘ কালো করে এলে হেসে ওঠে কদমগাছ। তখন তার মেঘাগমপ্রিয় নামের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে দিগন্তে। এ দৃশ্য দেখেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “গুরু গুরু ডাকে দেয়া,/ ফুটিছে কদম–কেয়া/ ময়ূর পেখম তুলে সুখে তান ধরছে/ বর্ষার ঝরঝর সারাদিন ঝরছে।” বলে রাখা ভালো, কদমতলীতে কদমগাছের আধিক্য থাকলেও রাধার জমজমাট কাহিনি যে থাকবেই তার কোনো গ্যারান্টি নেই। তারপরও বাংলাদেশের স্থান নামের ইতিহাসে কদমের গুরুত্ব অনবদ্য।
হাল আমলের স্থাপত্যকলার উপস্থিতি দেখে কে বলবে ঢাকা শহরের কদমতলী নামের থানা এলাকায় একসময় কদমগাছের আধিক্য ছিল! কদমতলী বা কদমতলার প্রাচীন মানুষদের জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তাঁরা আপনাকে নিজেদের বাঁদরামির গল্পসহ শুনিয়ে দেবে সেই জায়গার আপনার জন্মের আগের ইতিহাস।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দুনিয়ায় এই বর্ষায় কখনো হঠাৎ করে যদি কোনো বুটিক হাউসের জামাকাপড়ের নকশার নাম দেখেন কদমের নামে, তাহলে অবাক হবেন না যেন। হালে নারী–পুরুষের ঋতুকেন্দ্রিক পোশাকের নকশা করার যে চল হয়েছে, তাতে বর্ষা ও কদমের কদর একটু ওপরের দিকেই। নারীদের সালোয়ার-কামিজ কিংবা পুরুষদের টি–শার্টে দেখা যায় বর্ষা ও কদমের চিত্তাকর্ষকসব নকশা।
কোনো জিনিস ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা বোঝা যায় সেই জিনিসটির নামে খাবারের নামকরণ থেকে। যেমন ধরুন, শিঙাড়া। পানিফলের হিন্দি নাম শিঙাড়া। প্রাচীন ভারতের খুব গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপকরণ ছিল এই পানিফল। তার আকৃতির সঙ্গে মিল আছে বলেই আলুসমৃদ্ধ খাবারটির নামকরণ হয়েছে শিঙাড়া। তেমনি কদমের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েই কি না কে জানে, বাংলার ময়রারা একটি মিষ্টিজাতীয় খাবারের নাম রেখেছিলেন কদমা। নামটি যে কদম থেকে এসেছে, সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, এর আকার-আকৃতি কদমের মতো। চিনি দিয়ে তৈরি করা সাদা রঙের কদমা হচ্ছে বাংলার প্রাচীনতম মিষ্টিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর একটি ‘সফট ফিউশন’ প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়, গোল মণ্ডের মধ্যে যার ওপর দেওয়া থাকে হোমিওপ্যাথির দানা।
অনেক হলো গালগপ্প। পুনশ্চের বালাই না রেখে এই বেলা ইতি টানা যাক কদমচরিত।