বর্ষাকালে স্যাঁতসেঁতে ও ভেজা আবহাওয়ার কারণে ত্বক বা ত্বকের খোসপাঁচড়া, ছত্রাক সংক্রমণ, স্ক্যাবিস-জাতীয় ত্বকের নানা ধরনের অসুখ হয়ে থাকে। ভেজা শরীর ভালোভাবে না মুছলে, ভেজা কাপড় ভালোভাবে না শুকিয়ে গায়ে দিলে, ঘর স্যাঁতসেঁতে ইত্যাদি কারণে ত্বকের সমস্যা হয়।
এ সময়ে যেসব চর্মরোগ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তার মধ্যে ঘামাচির পরই ছত্রাকজনিত চর্মরোগ অন্যতম। কারণ, ঘর্মাক্ত এবং ভেজা শরীরই হলো ছত্রাক জন্মানোর উর্বর ক্ষেত্র।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাসুদা খাতুন বলেন, বর্ষাকালে লাগাতার বৃষ্টির কারণে প্রায়ই রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে থাকে। রাস্তার এসব ময়লা পানি ত্বকে লাগলে মারাত্মক সংক্রমণ হতে পারে। এ সময় ত্বক বৃষ্টি বা ঘামে ভেজা থাকলে সহজেই ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। বৃষ্টির পানি লাগলে দ্রুত তা পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে ও শরীর ভালোভাবে মুছে দিতে হবে। আর যাঁরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে ততটা সচেতন নন, তাঁদেরই এই রোগগুলো বেশি হতে দেখা যায়।
ছত্রাকের আক্রমণ
শীতপ্রধান দেশের চেয়ে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের বেশি লোক এই ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। রোগটির চিকিৎসা দেওয়া হলে খুব সহজেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু হতাশার দিক হচ্ছে যে কিছুদিন যেতে না-যেতেই পুনরায় দেখা দেয়। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একটু ভালো হওয়া মাত্রই রোগী ওষুধটি বন্ধ করে দেন। আবার যাঁরা ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করেন, তাঁরাও কিন্তু ঠিকমতো ব্যবহার্য কাপড়চোপড় পরিষ্কার করেন না বা রাখেন না, ফলে খুব সহজেই কাপড়চোপড় থেকে পুনরায় ছত্রাক দেহে প্রবেশ করে এবং সে কারণেই রোগটি কিছুদিনের মধ্যে পুনরায় দেখা দিতে পারে।
কী কী ধরনের ছত্রাক রোগ এ সময়ে হতে পারে?
মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন: ১. দাদ ২. ছুলি ও ৩. ক্যানডিডিয়াসিস। এই তিন ধরনের ছত্রাক-প্রজাতিই মূলত ত্বকের বাইরের অংশকে আক্রমণ করে এবং সেই আক্রমণ স্যাঁতসেঁতে, নোংরা, ঘর্মাক্ত দেহে সবচেয়ে বেশি হতে দেখা যায়।
দাদ শরীরের যেকোনো স্থানে দেখা দিতে পারে। তবে দেখা গেছে সাধারণত তলপেট, পেট, কোমর, পাছা, পিঠ, মাথা, কুঁচকি ইত্যাদি স্থানে বেশি আক্রান্ত হয়।
টিনিয়া ভারছিকলার বা ছুলিও একটি ছত্রাকজনিত রোগ। মানুষ গরমকালে এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়, শীতকালে আবার এমনিতেই যেন মিলিয়ে যায়। আবার গরম এলে ঘাড়ের চামড়া ভেজা থাকে। সেখানেই সাধারণত বেশি হয়ে থাকে, যা দেখতে হালকা বাদামি, সাদা গোলাকৃতির মতো দেখা যায়। বুকে, গলার দুই পাশে ঘাড়ে, পিঠে, বগলের নিচে, এমনকি সারা শরীরে হতে পারে। এতে ত্বক দেখতে সাদা হয়। তাই অনেকেই আবার একে শ্বেতি ভাবতেও শুরু করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শ্বেতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
ক্যানডিডিয়াসিসও একটি ছত্রাকজনিত চর্মরোগ। যাঁদের শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, যেমন শিশু, বৃদ্ধ কিংবা রোগাক্রান্ত, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করেছেন কিংবা যাঁদের ত্বকের ভাঁজ পানিতে অথবা ঘামে সব সময় ভেজা থাকে, তাঁদেরই রোগটি বেশি হয়; যাঁরা সব সময় পানি নড়াচড়া করেন, তাঁদের আঙুলের ফাঁকে, হাতের ভাঁজে, শিশুদের জিহ্বা, নারীদের যোনিপথে এবং গর্ভবতী নারীরা এতে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এতে ত্বকের আক্রান্ত স্থান একটু লালচে ধরনের দেখা যায় এবং সঙ্গে প্রচুর চুলকানি হয়ে থাকে।
ছত্রাক থেকে দূরে থাকা যায় কীভাবে?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছত্রাক সংক্রমণ প্রায় ১০০ ভাগ নিরাময় করা সম্ভব। তবে সেটা আবারও হতে পারে। কারণ ত্বকে ফাঙ্গাস বেড়ে ওঠার পরিবেশ সৃষ্টি হলে সেখানে ফাঙ্গাস বেড়ে উঠতে চেষ্টা করবে। তাই ফাঙ্গাস প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, সেগুলো হচ্ছে পা, আঙুলের ফাঁক, নখের গোড়া ভালো করে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। আর ত্বক পরিষ্কার বা ধোয়ার পর শুষ্ক টাওয়েল দিয়ে ভেজা স্থান মুছে শুষ্ক করে ফেলতে হবে। বিশেষ করে আঙুলের ফাঁক, ঊরুসন্ধির ভাঁজ, বগল, ঘাড়, মাথার চুল ইত্যাদি পুরোপুরি শুকনা না করলে সেখানে ফাঙ্গাস বেড়ে উঠতে পারে।
হতে পারে ত্বকের ছোঁয়াচে রোগ
স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়া ত্বকের একটি ছোঁয়াচে রোগ। যে কেউ যেকোনো সময় এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বর্ষাকালে এর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। চুলকানি হলো প্রধান উপসর্গ আর রাতে সেই চুলকানি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এমনকি ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে ঘা হতে পারে।
কীভাবে ছড়ায়?
অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন, এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে বিছানায় শুলে কিংবা ব্যবহৃত কাপড় অন্য কেউ ব্যবহার করলে খুব সহজেই এ রোগ ছড়াতে পারে। কারণ, জীবাণুটি ব্যবহৃত কাপড়ের মধ্য দুই দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। শিশু-কিশোরেরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে।
অন্যান্য রোগও কমবেশি হয়ে থাকে। তবে কিছু সাধারণ নিয়মকানুন যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিয়মিত গোসল ইত্যাদি মেনে চললে এসব রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
এ সময়ের সচেতনতা
এ সময় ভারী জামা-কাপড় না পরে হালকা রঙের সুতি পাতলা জামা পরুন। ঘামে ভিজে গেলে দ্রুত পাল্টে নিন। ভেজা কাপড় পরে থাকলে ছত্রাক সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি।
নিয়মিত প্রয়োজনে দিনে দুবার গোসল করুন। জীবাণুনাশক সাবান ব্যবহার করতে পারেন। ঘামে বা বৃষ্টিতে ভিজলে ত্বক ধুয়ে শুকিয়ে নিন।
এ সময় সারা দিন জুতা-মোজা না পরে বরং খোলা স্যান্ডেল পরা ভালো। তবে খালি পায়ে হাঁটবেন না। রাস্তায় এখন যত্রতত্র নোংরা পানি জমে থাকে। পায়ের ত্বককে এই নোংরা পানি থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। কেননা, এই পানিতে রয়েছে হাজার রকমের জীবাণু।
ভেজা চুল ভালো করে শুকিয়ে নিয়ে তবে বাঁধবেন, নইলে মাথার ত্বকে সমস্যা হতে পারে।
বাড়িতে কারও ছত্রাক সংক্রমণ হয়ে থাকলে শিশুদের তাঁর কাছ থেকে দূরে রাখুন।
লেখক: চিকিৎসক