৫ আগস্ট দুপুরের পরই রাজশাহীর মানুষ রাস্তায় নেমে আসে বাংলাদেশের পতাকা জড়িয়ে, কেউ মাথায় বেঁধে। তার খানিক পরেই বিজয়ের প্রাক্কালে, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগে মেতে ওঠে কিছু মানুষ। খবর আসতে থাকে সরকারি স্থাপনাসহ অনেক জায়গায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ হয়েছে। পুরো শহর ধোঁয়াটে হয়ে আসে। অন্যান্য জায়গার মতো রাতভর লুটপাট, ভাঙচুরের মধ্যে আতঙ্কে রাত কাটায় নগরবাসী।
৬ আগস্ট বিকেল চারটা নাগাদ খবর পাই রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যানে দুষ্কৃতকারীরা হরিণ চুরির চেষ্টা করছে। দ্রুত আমরা কিছু চলচ্চিত্রকর্মী সেখানে পৌঁছে দেখি, এলাকাবাসী ও অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের চেষ্টায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে। চারদিকে এমন আতঙ্কের মধ্যেই রাতে খবর পাই, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরেও দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে, যদিও সেটা ছিল গুজব। আরও নতুন নতুন স্থাপনায় আক্রমণের খবর আসে।
এরপর আমরা আর বসে থাকতে পারিনি। পরের দিন সন্ধ্যায় পরিচিত মানুষদের নিয়ে জাদুঘরের সামনেই সমাবেশ করি। অল্প সময়ের ডাকেই সেখানে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকর্মীসহ নানা পেশাজীবী মানুষ উপস্থিত হন। সেদিনই আমরা সবার মতামতের ভিত্তিতে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে ‘সেভ রাজশাহী’ নামে একটি গ্রুপ খুললাম। সেদিন রাতেই আমরা ১০০-এর বেশি সদস্য নিয়ে নগর পাহারায় নেমে গেলাম। জাদুঘরসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, পাড়া-মহল্লা ও রাস্তাঘাটে আমরা পাহারা বসাই। এ ছাড়া একটি টহল দলও প্রস্তুত করি, যারা শহরের যেখানেই সমস্যার কথা শুনেছে, ছুটে গিয়েছে। প্রথম দুই রাত সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়ি গুজব নিয়ে। পরবর্তী সময়ে আমরা কোনটা গুজব আর কোথায় সত্যিই অঘটন, সেটা আলাদা করার পন্থা উদ্ঘাটন করি। এরই মধ্যে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপে সদস্য হয় প্রায় এক হাজারের মতো মানুষ।
শুধু আমরাই যে একত্র হয়ে কাজ করেছি, তা কিন্তু নয়। ছাত্র-জনতা ও নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যেমন রেড ক্রিসেন্ট, জাতীয় তরুণ সংঘ, রোভার স্কাউট, বিএনসিসি মিলে এই শহরকে নিরাপত্তা দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে লুট হয়ে যাওয়া জিনিস উদ্ধার, সারা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ এবং শহরকে দেয়ালচিত্র দিয়ে সাজানোর কাজ করেছি। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এক হয়ে কাজ করার ফলে খুব অল্প সময়ে শহরের পরিস্থিতি অনুকূলে আনা সম্ভব হয়েছে।
প্রথম থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ন্যায্য দাবিতে আমরা একমত ছিলাম। কিন্তু দেশব্যাপী আন্দোলনে ছাত্রদের যখন গুলি করে মারা হলো, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে সারা দেশে ক্র্যাকডাউন করা হলো, আরও আরও মৃত্যুর খবর আসতে লাগল—তখন আর বসে থাকা গেল না। আগস্টে আমরাও রাজপথে নেমে গেলাম। আন্দোলনে নেমে উপলব্ধি করলাম যে সময়টা ধরে রাখা প্রয়োজন। ২০২৪-এর এই আন্দোলন একটি গণ-অভ্যুত্থান। আমাদের অনেক ঘটনার ইতিহাস বিকৃত হয়ে গেছে। এর আগে আমরা আমাদের ইতিহাসকে যথাযথভাবে আর্কাইভ করতে পারিনি বলে অনেক সময় ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে এবং সত্য তথ্যও মুছে গেছে। এই ইতিহাসটা যেন ঠিকঠাক থাকে, সেই কারণে আমরা ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম প্রোডাকশন থেকে রাজশাহীর আন্দোলন এবং তার পরবর্তী অবস্থা ভিডিও আর্কাইভ করছি। মাঠে-ঘাটে কাজ করে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমরা মানুষের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতে পেরেছি। আরও গভীরে গিয়ে সমস্যা দেখতে পেরেছি।
‘সেভ রাজশাহী’ একেবারে সময়ের প্রয়োজনে হয়েছে। ইতিমধ্যে এটা এমন একটা মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এখানে কেউ সমস্যার কথা বললে সবাই তার সমাধানে ছুটে যায়। কঠিন এ পরিস্থিতি শেষ হলে এটা কীভাবে কাজ করবে, কী পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যাবে, সেটা ‘সেভ রাজশাহী’র সদস্যরা সময়ের তাগিদেই ঠিক করবেন। নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে আমাদের একত্র থাকতে হবে এবং একত্রে কাজ করে যেতে হবে।
লেখক: ‘সেভ রাজশাহী’র অন্যতম উদ্যোক্তা ও চলচ্চিত্রনির্মাতা