আজ বাবা দিবস। এ উপলক্ষে পাঠকের কাছ থেকে লেখা আহ্বান করেছিলাম আমরা। বাবাকে নিয়ে লিখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী রূপশ্রী হাজং
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই আছে আমার বাবা বিশ্বজিৎ কুমার সরকারের অবদান। যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে, তাঁকে অনেক পরিশ্রম করতে দেখেছি। এত পরিশ্রমের একমাত্র কারণ আমি। আমাকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে দিন-রাত খেটেছেন বাবা।
আমাদের এলাকাটা একেবারে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা ছোট্ট একটা গ্রাম। সেই হিসেবে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা প্রযুক্তির নাগালের বাইরে। বাবার ইচ্ছা ছিল, তাঁর ছবি আঁকার শখটা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার। পাঠ্যবইয়ের ছবি দেখে দেখে আঁকাআঁকি শুরু করেছিলেন; কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে বেশি দূর এগোতে পারেননি। তাঁর স্বপ্ন আর ইচ্ছাই পরে আমার ওপর ভর করে।
হারিকেন জ্বালিয়ে দিনরাত ব্যানার ও সাইনবোর্ড লিখতেন বাবা আমার পড়ালেখার খরচ জোগানোর জন্য। তিনি ছবি আঁকার সময় তাঁর পাশে বসে থাকতাম; আর রং নিয়ে খেলাধুলা করতাম। এখনো মনে আছে, আমার আঁকার আগ্রহ দেখে বাবা মীনা কার্টুনের বই, খাতা ও রং এনে দিয়েছিলেন। বাবাকে দেখেছি, ছবি আঁকার পর তুলিগুলো যত্নে রাখতে। পরে বুঝেছি, আসল কারণ হলো তুলির স্বল্পতা। কীভাবে মিতব্যয়ী ও গোছালো হতে হয়, এসবও তাঁর কাছে থেকেই শিখেছি প্রতিনিয়ত।
পড়াশোনার জন্য ছোটবেলা থেকে আমাকে বাড়ি থেকে দূরে মিশনারি হোস্টেলে রেখেছেন। যেন উন্নত শিক্ষার সুবিধাটা পাই। একপর্যায়ে হাতে লেখা ব্যানার ও সাইনবোর্ডের চল উঠে যায়। বাবার আর্থিক উপার্জন কমে যেতে থাকে। তখন ফল চাষ, চাষাবাদ ইত্যাদি থেকে আয়ের কিছু অংশ দিয়ে আমার পড়াশোনার খরচ চালিয়ে গেছেন। এভাবে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা বাড়ালাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম চারুকলা বিভাগে। যেদিন আমাদের সমাবর্তনের মাহেন্দ্রক্ষণ এল, বাবার চোখেমুখে আনন্দাশ্রু দেখেছি। মা-বাবা দুজনই খুব খুশি হয়েছিলেন। সমাবর্তনের গাউনটি গায়ে জড়িয়ে হাত বোলাচ্ছিলেন বাবা। সেদিন মনে হয়েছে, তাঁর এত দিনের কষ্ট ও পরিশ্রমের সম্মান দিতে পেরেছি।
আলাদিনের জাদুর চেরাগের দৈত্য যদি কখনো আমাকে তিনটি ইচ্ছা পূরণের সুযোগ দেয়, তাহলে আমি নিজের জন্য কিছুই চাইব না। শুধু চাইব বাবার খুশি, সুস্থতা আর আনন্দময় জীবন।
শেষে এটুকুই বলতে চাই—‘ময় তাংকে বালা পায় বাবা তগে’ (আমি তোমাকে ভালোবাসি বাবা)।