শচীন টেন্ডুলকারের যে রেকর্ডকে মনে করা হতো অবিনাশী, গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে সেটাকেই ভেঙে যেতে দেখলেন স্বয়ং শচীন টেন্ডুলকার। তাঁকে ছুঁয়ে মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে আবার ছাড়িয়েও গেলেন তাঁকেই আদর্শ মেনে বেড়ে ওঠা ব্যাটসম্যান, ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন, সাবেক ক্যাপ্টেন বিরাট কোহলি। তারপর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দুই হাত তুলে মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করলেন গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের উদ্দেশে। তিনি আর কেউ নন, শচীন টেন্ডুলকার, পুরো গ্যালারির সঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনিও তালি দিচ্ছিলেন তখন। নিজের জীবন, দুঃসময়, পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসা নিয়ে প্রকাশ্যে খুব কমই কথা বলেছেন বিরাট। চলতি বছরের মার্চে আইপিএলের রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর নারী ক্রিকেটারদের উদ্দেশে যে ভাষণ তিনি দেন, সেখানে তার কিছুটা আছে, এখানে রইল তারই নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।
১৫ বছর ধরে আইপিএল খেলছি, কোনো দিন ট্রফি ছুঁয়ে দেখিনি। একবার টানা ছয় ম্যাচ হারলাম। এরপর ছিল দলের একটা পুনর্মিলনী। সেখানে গিয়ে প্রথম যে মানুষটার সঙ্গে দেখা হলো, তিনি এবি ডি ভিলিয়ার্স। আমরা এমনভাবে আলাপ জুড়ে দিলাম, যেন ক্যারিয়ারে আমরা কোনো দিন পরপর ছয় ম্যাচ হারিনি। কেননা, হতাশা নয়, আমাদের আশা ধরে রাখতে হবে। আশা নিয়ে এগোতে হবে। সামনের ম্যাচের জন্য।
দলের দায়িত্ব নিয়ে আইপিএলে কোনো দিন আমি ট্রফি জেতাতে পারিনি। কিন্তু আমি কখনো মনে করি না, ইশ্, যদি জিততাম! ১৬তম বার যখন খেলতে যাব, তখনো জেতার ব্যাপারে একই রকম উত্তেজিত আর আশাবাদী থাকব। মাঝেমধ্যে সেরাটা খেলেও হেরে যাওয়ার দায়ভার নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না। খেলায় ভালো দিন, খারাপ দিন থাকবেই। তবে হার, জিত যা-ই হোক না কেন, নিজের ১১০ ভাগ দিয়ে খেলতেই হবে। আর এটাই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব।
মাঝেমধ্যে ১ শতাংশ সম্ভাবনাও যথেষ্ট। আপনি আপনার সেরাটা দিয়ে সেই ১ শতাংশকে ১০ শতাংশে নিয়ে যাবেন। আপনার খেলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্যরা সেটাকে আরও তিন গুণ বাড়িয়ে জেতার সম্ভাবনাকে ৩০ শতাংশে নিয়ে যাবে। তারপর সবাই মিলে নিজের সেরাটা ঢেলে দিলে, দিনটা ভালো হলে (ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে) সেই ১ শতাংশ সম্ভাবনা দিয়েও আপনারা ম্যাচটা বের করে আনতে পারেন। ম্যাজিকটা ঘটে যেতেই পারে।
এমনও সময় গেছে যখন (২০২১ সালের নভেম্বরে) টি-টোয়েন্টি আর (২০২১ সালের ডিসেম্বরে) ওয়ানডের ক্যাপ্টেনসি ছাড়ার পর আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে আর কত দিন খেলব। ক্যারিয়ার নিয়ে আমার ভেতরে নিরাপত্তাহীনতা ভর করেছিল। আমি হয়তো একটা ম্যাচে মাঠে নামছি, জানতাম না যে পরের ম্যাচে কী হবে। সত্যি কথা বলতে কি, সেই সময় আমার ভেতর আর কোনো আশাই অবশিষ্ট ছিল না। কেবল ভাবতাম, আমার কাছ থেকে সবাই কী চায়। কেবল ভাবতাম, আউট হলে আমার চলবে না। আমাকে পারফর্ম করতেই হবে। ‘সেফ’ খেলার জন্য আমি বলই ছেড়ে দিতাম। অন্যরা আমাকে জিজ্ঞেস করত, তুমি স্ট্রাইক কেন করলে না? আমিও ভাবলাম, তাই তো। অন্যের প্রত্যাশা পূরণের চাপে নিজের স্বাভাবিক খেলাটাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম!
যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্ভার থাকাটা খেলার অংশ। যখন কিছুই আপনার মনমতো হচ্ছে না, তখনো মানসিকভাবে শক্তিশালী আর ইতিবাচক থাকার কোনো বিকল্প নেই। নিজের ভেতরকার আগুন আর উত্তেজনাকে জিইয়ে রাখতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, ‘তুমি স্ট্রাইক কেন করলে না’, কথাটা আমাকে ফিরিয়েছিল। যখন থেকে আমি অন্যরা আমার কাছ থেকে কী চায়, সেটা ভুলে আবার নিজের স্বাভাবিক খেলাটা খেলার চেষ্টা করলাম, আমি ফিরতে শুরু করলাম। আপনি হয়তো পরপর পাঁচটা ম্যাচ জিতবেন না, তবে মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়তে হবে। মুখে হাসি ধরে রাখতে হবে। নিজের ভেতরের আগুনকে উসকে দিয়ে প্রতিবার নিজের সেরাটা ঢেলে দিতে হবে। খারাপ দিন পার করে আসতে হবে। কেননা, ভালো দিন আর খারাপ দিন খেলোয়াড়দের জীবনের অংশ। আর প্রতিপক্ষকে জিতিয়ে দেওয়ার জন্য আপনি এখানে আসেননি।