সব মা–বাবাই সন্তানের মঙ্গল চান। এই চিন্তা মাথায় রেখেই তাঁরা সন্তান লালনপালন করেন। তবে সবার সন্তান পালনের ধরন এক রকম নয়। একেক দেশের সমাজব্যবস্থা, পারিবারিক মূল্যবোধ অনুযায়ী তা একেক রকম হয়। আবার একই সমাজের মধ্যেও চালু আছে নানা রকম ধরন। আমাদের এখানে কয়েক বছর আগেও কর্তৃত্বপরায়ণ বা কঠোরভাবে (অথরেটেটিভ প্যারেন্টিং) সন্তান পালনের ধরনটিকে তুলনামূলক কার্যকর বলে বিবেচনা করা হতো। আজকাল আবার যেমন জেলিফিশ প্যারেন্টিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে খুব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এই ধরন এখন বেশ জনপ্রিয়। এখানে শিশু–কিশোরদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা আর নিজের মতপ্রকাশের সক্ষমতা সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। সন্তানের ইচ্ছাই এখানে সব।
কেন এটি জেলিফিশ প্যারেন্টিং
জেলিফিশ যেমন নরম, তুলতুলে; জেলিফিশ ধরনের মা-বাবারাও তেমনই। নিজেদের কোনো সিদ্ধান্ত তাঁরা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেন না। নমনীয়ভাবে তাঁরা সন্তান লালনপালন করেন। এ ধরনের অভিভাবকেরা সন্তানের জন্য কোনো নিয়মকানুন তৈরি করেন না। সন্তানের ইচ্ছার সঙ্গে তাঁরা তাল মিলিয়ে চলেন, সন্তানের নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
সন্তানের সব সিদ্ধান্তে মা–বাবা সায় দেন। অনেকটা সন্তানের নেতৃত্বেই মা–বাবা পরিচালিত হন।
মা–বাবা সন্তানের সামনে রোলমডেল হিসেবে দেখা দেন না।
সন্তানকে সাধারণত কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় না, সন্তানের জন্য তেমন নিয়মও দাঁড় করান না।
সন্তানের সঙ্গে কোনো বিষয়ে বিরোধে জড়ান না।
সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের প্রত্যাশাও তেমন থাকে না।
জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ে সন্তান পালনের সুবিধা, অসুবিধা, ভালো–মন্দ—দুইই আছে।
ভালো দিক
সন্তানের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
সন্তানের সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ তৈরি হয়।
সন্তানেরা একটি কমফোর্ট জোনে (চাপহীন আরামদায়ক বলয়) থেকে বড় হয়। মা–বাবার কাছেও নিরাপদ বোধ করে।
বাবা–মায়ের কাছে এ ধরনের সন্তানেরা কিছু গোপন করে না।
এ পদ্ধতিতে সন্তানদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা ও দক্ষতা তৈরি হয়। তারা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে ওঠে।
সন্তানেরা বাইরের জগতকে ভালোভাবে বুঝতে শেখে।
যেকোনো পরিবর্তনকে তারা সহজভাবে নিতে পারে। যেকোনো পরিস্থিতিতে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ নিতে পারে।
সন্তানের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি গড়ে ওঠে। তারা সফলভাবে নিজের ক্যারিয়ার সাজিয়ে নিতে পারে।
মন্দ দিক
বাবা–মায়ের নজরদারি না থাকায় সন্তানের বখে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। চারপাশের নেতিবাচক পরিবেশ দ্বারা সন্তান সহজেই খারাপ দিকে প্রভাবিত হতে পারে।
সন্তানের জীবনের লক্ষ্য ঘন ঘন পরিবর্তিত হতে পারে। এটা তার মনকেও বিচলিত করে তুলতে পারে।
সন্তানেরা যেহেতু কোনো নিয়মকানুনের মধ্যে বড় হয় না, তাই সহজেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে পারে তারা।
নিজে নিজে সব সমস্যার সমাধান করতে হয় বলে তাদের মধ্যে উদ্বেগ বা স্ট্রেস দেখা দিতে পারে। মনের ওপর পড়তে পারে বাড়তি চাপ।
নেতিবাচক পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা না থাকায় কখনো বিপদে জড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন রাত করে বাড়িতে ফেরার সময় খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পারে।
জেলিফিশ প্যারেন্টিং পশ্চিমা দুনিয়ায় কার্যকর হলেও আমাদের দেশের জন্য কতটুকু উপযোগী, অনেকের মনেই এ প্রশ্ন আছে। কেবল প্যারেন্টিংকে জেলিফিশ মডেলে নিয়ে গেলাম আর সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করতে পারলাম না, তাহলে সেটা সফল হবে না। চারপাশকে সন্তানের জন্য উপযোগী করতে না পারলে জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের কার্যকারিতা কমে যাবে। তাই সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ইতিবাচক না হলে জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের উপকারিতা পাওয়া যাবে না। তখন বরং শিশুরা দ্বিধার মধ্যে পড়ে যাবে।
আর বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো মা–বাবাই সন্তান পালনে সব সময় একটি ধরনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন না। বরং ভারসাম্য রক্ষা করে সব ধরনের প্যারেন্টিং স্টাইল থেকে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে নিজ সমাজসংস্কৃতির উপযোগী করে নেওয়া গেলে কার্যকর হবে। এ দেশের পেক্ষাপটে জেলিফিশ প্যারেন্টিংয়ের মন্দ দিকগুলো মাথায় রেখে চারপাশের উপযোগী করে সন্তান পালন করতে হবে। ভারসাম্যমূলক প্যারেন্টিংই সন্তানের মনোসামাজিক বিকাশকে সাবলীল করতে পারে।
মোদ্দাকথা হলো নাটাইয়ের নিয়ন্ত্রণ রেখে ঘুড়িকে উড়তে দিন। তবে ঘুড়িকে এত ওপরেও ওড়ানো যাবে না, যাতে সুতা কেটে যায়। আবার কেটে যাওয়ার ভয়ে নাটাইয়ের সঙ্গে ঘুড়িকে লেপটে রেখে তার ওড়াউড়ি বন্ধ করা যাবে না।