আমরা মায়ের হৃদয়ের দুটি ভাগ

তাঁরা যমজ। একই স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। একই রকম মেধাবী কি না, সেটা তাঁদের গল্প পড়েই বুঝে নিন।

দুই ভাই অলিন্দ ও নিলয়
ছবি: সংগৃহীত

আমরা দুই ভাই। কে বড়, কে ছোট—তা নিয়ে সংশয় আছে। চিকিৎসকের ভাষ্যে, দুজনের জন্মের ব্যবধান ৩ সেকেন্ড। ৩ সেকেন্ডের ছোট-বড় কি সত্যিই কেউ হতে পারে? তাই ওসবে কান না দিয়ে আমার মা আমাদের নাম রেখেছেন হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠের নামে। অলিন্দ আর নিলয়, আমরা মায়ের হৃদয়ের দুই ভাগ।

আমার মা চিত্রা মিত্র মজুমদার ছিলেন বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষক। বাবা দেবাশীষ গুপ্ত ব্যবসায়ী। ছোটবেলায় আমরা বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতাম। একবার আমরা মায়ের কলেজে গিয়েছিলাম। আমাদের দেখতে মায়ের ঘরে রীতিমতো ভিড় জমে গিয়েছিল। আরেকবার মায়ের সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার পর এতবার আমাদের নাম জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে বিরক্ত হয়ে আমরা একজন আরেকজনের নাম বলা শুরু করি। স্কুল ও কলেজজীবনে আমরা দুজনই ছিলাম একই ক্লাসে। সব সময় নিলয়ের রোল থাকত আগে আর আমার পেছনে। ও হ্যাঁ, আমি অলিন্দ গুপ্ত। আর আমার ভাই নিলয় গুপ্ত। লোকে অবশ্য অভ্র–শুভ্র নামেই আমাদের চেনে বেশি।

নটর ডেম কলেজের ফুটবল দলে আমাদের বেশ কদর ছিল। প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে দুজন একসঙ্গে মাঠে নামতাম। শিক্ষকেরাও বিভ্রান্তিতে পড়তেন। একবার নিলয় পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ায় বেশ বকুনি খায়। স্যারের কথা ছিল, দুজনই একই চালের ভাত খাই, কিন্তু নম্বর কেন কমবেশি। আবার স্কুলে কখনো মা-বাবার ডাক পড়লে আমরা আতঙ্কে থাকতাম। একজনের জন্য নালিশ করলেও শেষ পর্যন্ত বকা খেতাম দুজনই। বকার ভয়ে গলায় গলা মিলিয়ে জীবনে অনেক কেঁদেছি।

আমার ফেসবুক বৃত্তান্তে লিখেছি, ‘তুমি কোনটা?—অলিন্দ!’ জীবনে এতবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি যে সেটাই তুলে দিয়েছি। স্কুল-কলেজ শেষে আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগে আমাদের দুজনকে আলাদা করা ছিল দুষ্কর। জীবনে যত জায়গায় ঘোরাঘুরির জন্য গিয়েছি, আমার আর নিলয়ের রুম ছিল এক। একই সঙ্গে গিয়েছি। কুইজিং নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ব্যস্ত ছিলাম। একই সঙ্গে ক্লাব করেছি। আমি ছিলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট আর নিলয় প্রেসিডেন্ট।

আমরা দুজনই ব্রাজিল ফুটবল দলের সমর্থক, রিয়েল মাদ্রিদকে ভীষণ পছন্দ করি। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটবল ও কুইজের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছিলাম। পড়ার টেবিলের চেয়ে মাঠেই বেশি সময় দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অনেক ঘুরতাম। ছুটি পেলেই দেশের এখানে–সেখানে তো আছেই, কখনো কখনো চলে গেছি ভারত আর নেপালের পর্বতে।

কোনো কারণে ঝগড়া হলেও আমাদের মধ্যে চিৎকার-চেঁচামেচি হয় না। চোখের ইশারায় যা বলার বলা হয়ে যায়। নিলয় ভীষণ দায়িত্বশীল। আমাদের কাঁধে কোনো কাজ এলে আমি আয়েসে থাকি। জানি নিলয় শেষ করে দেবে।

বুয়েটের পড়াশোনা শেষ করে দেশের কয়েকটি কাজে পরামর্শক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। আমি পানি নিয়ে কাজ করি আর নিলয় সড়ক ও জনপদ নিয়ে। কিছুদিন কাজের পর আমরা উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাই। সেই একই গল্প। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটনে পড়ি আমরা। এখানেই থাকি। শুধু তা–ই নয়, একই বিভাগে স্নাতকোত্তর শুরু করি। আবার একই বিভাগের একই তত্ত্বাবধায়কের অধীন পিএইচডি গবেষণা শুরু করি।

পড়াশোনা, গবেষণা আর জীবনের নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত আমরা। সব শেষ ভ্রমণে গিয়েছিলাম লাস ভেগাসে। এখন অপেক্ষা করছি, দেশ থেকে মা–বাবা আসবে, তাদের নিয়ে যাব নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে।