প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় মা দিবস। সেই হিসাবে আগামীকাল মা দিবস। দিনটি উপলক্ষে মাকে নিয়ে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল ‘ছুটির দিনে’। সেই আহ্বানে বিপুল পাঠক সাড়া দিয়েছেন। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।
মা ও দুঃখ—শব্দ দুটো কি অবিচ্ছেদ্য? পৃথিবীর সব মা-ই কি ‘দুঃখিনী’? আমার মা কি দুঃখিনী ছিলেন? এত দিন পরে এসে জটিল এই অঙ্ক মেলাতে পারি না। তবে মাকে খুব কষ্ট করতে দেখেছি। নিম্নবিত্ত সংসারের মা ছিলেন বলেই কষ্টটা একটু বেশি ছিল কি না, কে জানে। মাকে দেখতাম সব সময় কেমন যেন একটা ভাবনার মধ্য দিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতেন। আমার চাকরিতে যোগদানের আগে এমন একটা দিন পাওয়া কঠিন, যেদিন মায়ের বকাবকি কিংবা সংসারের নানা কাজের শব্দ ছাড়া ঘুম থেকে জেগেছি। আর চাকরি শুরুর পর থেকে অফিস বন্ধের দিন ছিল যেন মায়ের ঘরদোর পরিষ্কার আর বিছানা-চাদর বদলানোর দিন। মনে হতো, আমি যেন ঘুমাতে না পারি, এ জন্যই এসব করছেন। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হতাম। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতাম না। মা যখন বকাঝকা করতেন, কেন জানি অদ্ভুত একটা ভাবনা আসত আমার মাথায়। মা কি আসলে আমাকে বকা দিচ্ছেন, নাকি তার কোনো চাপা কষ্ট প্রকাশ করছেন! মায়ের রাগারাগি, বকাঝকা, কথাবার্তা কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল পেতাম না। তাই হয়তো এমন মনে হতো। তবে কখনো এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি কোনো দিন।
একদিন মা বললেন, তাঁর পায়ে ব্যথা হচ্ছে। বললাম, এমআই রুমে (সৈনিকদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল) যাও। মা গেলেন। কিন্তু সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ব্যথা ভালো হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। মা আবারও বললেন। আগের মতোই বললাম, আবার হাসপাতালে যাও। আর বিশ্রাম নাও। তখন প্রায়ই বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের আঙিনায় আড্ডা দিতাম। সেদিনও এক বন্ধুর সঙ্গে চা খাচ্ছি। এমন সময় হাসপাতাল থেকে ফোন। রোগের পূর্ব–ইতিহাস, কোথায় কোথায় দেখানো হয়েছে—এ রকম কিছু তথ্য জানতে চাইল। এই প্রথম মায়ের পাব্যথা আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিল।
কিছুদিন পর চিকিৎসক জানালেন, মায়ের কোমরে ছোট একটা টিউমার আছে। অস্ত্রোপচার করাতে হবে। আমরা প্রস্তুতিও নিতে থাকি। আমার বাবা একজন সৈনিক। তাঁদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত যে হাসপাতাল, সেখান থেকে তারিখ পাচ্ছিলাম না। কেবলই দেরি হয়ে যাচ্ছিল। আমরা অপেক্ষা করছিলাম আর মা ব্যথা সহ্য করছিলেন।
অবশেষে অপারেশন হলো। ১৫ দিন পর চিকিৎসকের কাছে আবার দেখাতে নিয়ে গেলাম। বায়োপসি রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক জানালেন, মায়ের একটু সমস্যা আছে। আর এখানে উন্নত চিকিৎসার তেমন সুযোগ নেই। এরপর অন্য হাসপাতালে রেফার করে দিলেন। অবশ্য ততক্ষণে আমরা সবাই জেনে গেছি মায়ের কী হয়েছে। কেবল জানতে পারেননি মা। মাকে নিয়ে আমরা লিফটে নামছি। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, আমি কোথাও যেন তলিয়ে যাচ্ছি। অদ্ভুত এক শূন্যতা ঘিরে ধরছে চারপাশ থেকে। মাকে হয়তো আর ফেরাতে পারব না! মরণব্যাধি ক্যানসারের শেষ পর্যায়ে আছেন মা।
তারপর শুরু হলো মাকে নিয়ে অনিশ্চিত এক চিকিৎসাযাত্রা। এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল, টেস্ট, রিপোর্ট, চিকিৎসকের সিরিয়াল—দিনরাত এক করে ফেলা দৌড়ঝাঁপ। চোখের সামনে দেখছি, প্রতিদিন একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছেন মা। এক হাতে সংসার সামলানো সর্বংসহা মা আমার একসময় নিজেকে সমর্পণ করলেন হুইলচেয়ারের কাছে। শক্তপোক্ত মানুষটা ধীরে ধীরে বিছানার সঙ্গে সেঁটে গেলেন। অস্ত্রোপচারের পর প্রায় ৯ মাস বেঁচে ছিলেন মা। পুরো সময়টাই ছিলেন কোনো না কোনো হাসপাতালে। এরপর এই মে মাসেরই এক দুপুরে মা চলে গেলেন।
আজকাল সকালে ঘুম ভাঙার পর চারপাশ কেমন নীরব লাগে। কোলাহল নেই, ঘর ঝাড়ু দেওয়ার শব্দ নেই, মায়ের বকাবকি নেই! মায়ের পান খাওয়া মুখে অদ্ভুত একটা গন্ধ ছিল। এখন গায়ে পারফিউম দিতে গেলেই গন্ধটা মনে পড়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সুগন্ধিও সেই গন্ধের কাছে কিছুই নয়। মায়ের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস যত্নে রেখে দিয়েছি। তছবি ও তিনটি চশমা কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছি। স্বচ্ছ কাচের ভেতর থাকা জিনিসগুলোর দিকে প্রায়ই তাকিয়ে থাকি। মাকেও অমন যত্নে বুকের ভেতর রেখে দিয়েছি।