নাজিফা তুষি হঠাৎ জ্বলে উঠে হারিয়ে যাওয়া আলো নয়

প্রতিবছর বাংলা নববর্ষে দেশের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে ‘ছুটির দিনে’। এবারও মুক্তিযুদ্ধ, গবেষণা, ক্রীড়া, সংগীত, চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, ব্যবসা ক্ষেত্রে উজ্জ্বল আট তরুণের গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে—গাই তারুণ্যের জয়গান। চলচ্চিত্র বিভাগে পড়ুন অভিনেত্রী নাজিফা তুষির গল্প।

নাজিফা তুষি

আমার মনে হয় না অভিনয় শেখা যায়। যেটা শেখা যায়, সেটা হলো নিজের আবেগ আর অনুভূতিকে কাজে লাগানো।

মারিয়োঁ কোতিয়ার, ফরাসি অভিনেত্রী

আমার করা চরিত্রগুলো আমাকে এতোটাই প্রভাবিত করে যে মাঝেমধ্যে তাদের সঙ্গে বসবাস করা কঠিন।

মারিয়োঁ কোতিয়ার, ফরাসি অভিনেত্রী

শক্তিশালী নারী চরিত্র সব সময় আমাকে টানে। আমি এমন কিছুই করতে চাই, যেটা আগে কেউ করেনি।

নাটালি পোর্টম্যান, মার্কিন অভিনেত্রী

উক্তিগুলো অকারণ নয়। আমার জানামতে, নাজিফা তুষি তাঁদের কাজ দেখে এবং তাঁদের বোঝার চেষ্টা করে। সে যা–ই হোক, মূল কথায় চলে যাই।

তুষি তরুণ আর সম্ভাবনাময়; তারুণ্যের উন্মাদনা আর উদ্দীপনার মধ্যেও তুষি অন্য অনেকের চেয়ে একটু ধীর–স্থির। আর সেটাই মনে হয় তাকে একটু আলাদা করে রেখেছে। চারদিকের এত অস্থিরতা আর আলোর ঝলকানি তুষিকে পেয়ে বসেনি। জনপ্রিয়তার শুরুতেই এই অস্থিরতা এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছা কজনের থাকে! তুষি সে অর্থে অবশ্যই আমাদের ভালোবাসা পেতে পারে। তাই শুরুতেই তাকে শুভকামনা।

তুষির সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৮ সালে। তখন আমরা হাওয়ার বিভিন্ন চরিত্রে কলাকুশলী নির্বাচন করছি। তখনো কিছু চরিত্র বাকি ছিল। আমরা ‘গুলতি’ চরিত্রের জন্য অভিনেত্রী খুঁজে যাচ্ছি। আমাদের লাগবে প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি, অফুরন্ত সময় দেওয়ার ইচ্ছা আর সবকিছু থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলার ক্ষমতা আছে, এমন কোনো অভিনেত্রী। আমাদের সিনেমার সম্পাদক সজল অলক একদিন তুষির ফেসবুকের একটা ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘ভাই, এই মেয়েকে কি বেদেনীর মতো লাগে?’

‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যে নাজিফা তুষি

তারপর হাওয়ার পোশাক পরিকল্পক আনিকা জাহিনের মাধ্যমে তুষির সঙ্গে আমাদের পরিচয়। একটা স্ক্রিন টেস্টও নেওয়া হলো। তুষি মোটামুটি করল। তার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে আমরা অন্য অনেকের টেস্ট নিতে থাকি। কিন্তু তুষি যেন গুলতি চরিত্রের সঙ্গে লেগে থাকে। আর সত্যি সত্যি একদিন আমরা বুঝতে পারি, তুষিই আমাদের গুলতি। তুষির এই তাড়না আমাদের মুগ্ধ করে। তুষি তখন শুনতে পছন্দ করে, অভিনয়ের কৌশল যে তখনো তার জানা নেই। বরং চরিত্রকে ভালোবেসে আবেগী হয়ে যাওয়া তুষিকে দেখে আমাদের মনে হয়েছিল, এই চরিত্র করার জন্য আমরা হয়তো এমন কাউকেই খুঁজছিলাম।

তারপর দীর্ঘ ছয়-সাত মাস মহড়া, অতঃপর শুটিং, এই পুরো সময় তুষি যেন গুলতি হয়ে ছিল। শুট শেষ হয়ে যাওয়ার অনেক পরও তুষিকে মাঝেমধ্যে আমাদের গুলতির মতো লাগত। আর ব্যাপারটা নিয়ে তুষি অনেক সমস্যারও মুখোমুখি হতো। চরিত্রের সঙ্গে এই যে বসবাস, এটা অভিনেত্রী হিসেবে সবচেয়ে আনন্দের, সেটাই হয়তো তুষি মনে করে।

নাজিফা তুষি

হাওয়ার শুট শেষ হয়ে যাওয়ার পর তুষিকে আমরা অন্যভাবে আবিষ্কার করি। অনেক কাজের মধ্যে নিজেকে না জড়িয়ে তুষি বরং ব্যস্ত হয়ে পড়ে থিয়েটার কোর্স নিয়ে। একরকম পাগলের মতো একটার পর একটা কর্মশালায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। আমি তুষির শেখার মনকে চিনতে পারি। তারপর আরও কিছু কাজের মাধ্যমে নিজেকে পরিণত করার ছাপ আমরা দেখতে পারি। আমি জানি এ যাত্রা তুষির অব্যাহত থাকবে। তুষি আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস ভৌতিক নয়। কোনো চরিত্র পেলে সেটাকে কীভাবে খুঁজে পাবে, তার জন্য সে হাতড়ে বেড়ায়। আর সেটাই তুষির সুন্দর দিক।

এ যাত্রা সুদীর্ঘ, সামনে নিশ্চয়ই আরও বহুমুখী ও শক্তিশালী চরিত্র তুষি খুঁজে নেবে। আমরা সেই পরিণত অভিনেত্রীকে দেখার অপেক্ষায় থাকব।

সার্চলাইটের মতো হঠাৎ জ্বলে উঠে হারিয়ে যাওয়া আলো তুষি নয়, বরং জোনাকির মতো জ্বলজ্বলে সুন্দর আলোতে তুষি নিজেকে আলোকিত করুক। আমরা সেই আলো দেখার অপেক্ষায়…

লেখক: নির্মাতা