বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র মাহবুবুর রহমান। লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতা
১৫ জুলাই সকাল থেকেই মেসের বন্ধু ও রুমমেটদের মধ্যে একটা চাপা শঙ্কা টের পাচ্ছিলাম। সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ততক্ষণে বলে দিয়েছেন—আন্দোলনকারীদের দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। অতএব বুঝতে পারছিলাম, আজ আমাদের ওপর আক্রমণ হবে। কিন্তু তাই বলে ঘরে তো বসে থাকতে পারি না। যদি অধিকার আদায়ে সোচ্চার না হই, পরের প্রজন্মের কাছে কী জবাব দেব! আরেকটি বিষয়ও আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করছিল, সেটা হলো আমাদের নারীসমাজ। সামনে থেকে দেখেছি, আন্দোলনে মেয়েরা কতটা অগ্রগামী। একজন বোন যদি হাজারো প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে আন্দোলনে আসতে পারে, আমি কেন পারব না!
সেদিন আমাদের কর্মসূচি ছিল শহরে। সেই উদ্দেশ্যে দুপুর আড়াইটার শাটল ট্রেনে উঠি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরও সেদিন শাটল ছাড়ছিল না। বাইরে বের হতেই দেখি ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতারা চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিকে জোর করে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যাচ্ছে—তাঁর ছাত্রত্ব বাতিল ও আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ানোর মুচলেকা আদায়ের জন্য।
তখন আমরা, শাটলে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিলে ক্যাম্পাসেই আন্দোলন গড়ে তুলি। রাফিকে উদ্ধার করতে প্রক্টর অফিসের দিকে রওনা হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের কাছাকাছি আসার পর আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায় ছাত্রলীগ। মিছিলের একেবারে সামনে থাকায় তাদের সব হিংস্রতা যেন আমার ওপর নেমে আসে। উপর্যুপরি আঘাতে মাথা ফেটে আমার সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। ধূসর রঙের টি-শার্ট খয়েরি বর্ণ ধারণ করে। রক্তক্ষরণ কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছিল না! ভেবেছিলাম, এটাই হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্ত। উপস্থিত একজন রিকশায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে যেতে বলেন। আমার মাথায় পাঁচটি সেলাই পড়ে। মনে আছে, তখন রথযাত্রার সময় ছিল। আমার অনুষদের ড. রূদ্রপ্রতাপ দেবনাথ স্যার রথযাত্রার সেই ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও আমাকে দেখতে এসেছিলেন। ওই রাতেই আমার মেজ ভাই চট্টগ্রামে আসেন। পরদিন আমাকে লক্ষ্মীপুরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়।
বাড়িতে এসেও শান্তিতে থাকতে পারিনি। স্কুলের অনুজেরা আমাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখলে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা–কর্মীদের রোষে পড়ি। তারা আমাকে ‘নব্য রাজাকার’ আখ্যায়িত করে। শুনেছিলাম, আওয়ামী লীগের নেতারা আমার নাম তালিকাভুক্ত করেছে—যেকোনো সময় গ্রেপ্তার বা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে পারি। এই আতঙ্কে নিজের ঘরে ঘুমাতে পর্যন্ত পারতাম না। বেশির ভাগ রাত নির্ঘুম কেটেছে। তবু দমে যাইনি। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর আবার আন্দোলনে যাওয়া শুরু করি। মৃত্যুর ভয় তখন একেবারে কেটে গিয়েছিল।
৫ আগস্ট—সব কষ্ট যেন নিমেষে উধাও হয়ে গিয়েছিল। রক্তে ভেজা আমার টি–শার্ট এখনো স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করে রেখেছি। পরবর্তী প্রজন্মকে যেন বলতে পারি, তার পূর্বপুরুষ কাপুরুষ ছিল না। এই টি-শার্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আজীবন অনুপ্রেরণা জোগাবে।