যাতায়াতের সুবিধার জন্য অনেক মেয়েই এখন স্কুটি কিংবা মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। এই স্কুটি বা মোটরসাইকেল চালনা শেখানোকেই পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অনেক মেয়ে। এমন একজন স্কুটি প্রশিক্ষক নাদিয়া আক্তার (২৪)। স্কুটি শিখিয়েই তিনি মাসে আয় করছেন লাখ টাকা।
নাদিয়ার প্রশিক্ষণ দেখতে গত ১৪ জুন সকালে আগারগাঁও ডাকঘরের পেছনের খোলা রাস্তায় গিয়ে হাজির হই। সেখানে দুই ছাত্রীকে স্কুটি চালনা শেখাচ্ছিলেন নাদিয়া আক্তার। নারীদের স্কুটি চালনা শেখাতে ২০১৯ সালে নিজের জমানো টাকা ও পরিবারের সহায়তায় একটি প্রশিক্ষণ স্কুল চালু করেন নাদিয়া, নাম দেন নিউ লেডি ড্রাইভিং স্কুল। প্রথমে একটি স্কুটি থাকলেও এখন তাঁর চারটি ভিন্ন ধরনের স্কুটি আর মোটরসাইকেল আছে। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের মার্কেটিং বিভাগে অনার্স শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছেন নাদিয়া। ক্লাসের পর দিনের বাকি সময় নারীদের স্কুটি ও মোটরসাইকেল চালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে কাটান।
বাসা থেকে কলেজ অনেক দূরে হওয়ায় ২০১৫ সালে একটি মোটরসাইকেল কেনেন নাদিয়া। তখন একটি ট্রেনিং সেন্টারে স্কুটি চালনা শিখতে গিয়ে দেখেন, মেয়েদের মোটরসাইকেল কিংবা স্কুটি চালনার চেয়ে শেখাটা বেশি চ্যালেঞ্জিং। অনেক মেয়েই স্কুটি চালনা শিখতে ট্রেনিং সেন্টারে আসছেন। কিন্তু পুরুষ প্রশিক্ষকের কাছে শিখতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন। ফলে অনেকে ট্রেনিং শেষ না করেই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। তখনই প্রথম নারীদের স্কুটি চালনা শেখানোর বিষয়টি মাথায় আসে। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করার কথা তখনো নাদিয়ার মাথায় আসেনি। ‘প্রথমে আশপাশের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে শেখাতে শুরু করি। এরপর পরিচিতদের মাধ্যমে আরও ডাক পেতে শুরু করি। অনেক আপু ফোন করে বলতেন, “লোকাল বাসে চলাফেরা করতে কষ্ট হয়, তাই স্কুটি শিখতে চাই।” তাঁদের কথায় আমি বেশ অনুপ্রাণিত হই,’ এভাবেই শুরুর গল্পটা বলছিলেন নাদিয়া।
২০২২ সালে হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান নাদিয়ার বাবা। মা ও ছোট ভাই থাকেন গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরে আর নাদিয়া ঢাকায়। বড় ভাই থাকেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। ড্রাইভিং স্কুল থেকে বেশ ভালো আয় থাকায় নিজের খরচ চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি পরিবারকেও সাহায্য করছেন নাদিয়া। অনার্স–পরবর্তী পরিকল্পনা জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি সব সময়ই খুব চঞ্চল। এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। তাই আগেই বুঝেছি যে আমাকে দিয়ে ৯টা-৫টা অফিস করা সম্ভব নয়। আমি সব সময় চেয়েছিলাম এমন কিছু করব, যেখানে প্রতিদিন নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হবে, নতুন সব অভিজ্ঞতা হবে। আমি তাঁদের শেখাব এবং তাঁদের থেকে শিখব।’
প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেন নাদিয়া। বেশির ভাগই নারী; কেউ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, কেউ চাকরিজীবী। নাদিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় আমাদের সামনে তাঁর দুই শিক্ষার্থী স্কুটি চালাচ্ছিলেন। তাঁদের অনুশীলনে খানিক সময়ের জন্য ব্যাঘাত ঘটালাম। ছাত্রীদের একজন জাহানারা ফেরদৌস, সবে ভর্তি হয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। জানালেন, ছোটবেলা থেকে শখ ছিল বাইক চালাবেন। সেই শখ পূরণ করতেই বাবা নজরুল ইসলামের হাত ধরে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন। স্ত্রীর শত বারণের পরও মেয়ের শখ পূরণ করতে সচেষ্ট বাবা বলছিলেন, ‘আমি জোর করে শেখাতে নিয়ে এসেছি।’ জাহানারা বলেন, ‘বেশির ভাগ ড্রাইভিং স্কুলেই মেয়ে প্রশিক্ষক নেই। শেখার ইচ্ছা থেকে ফেসবুকে খুঁজতে খুঁজতে নাদিয়া আপুর স্কুলটি পেয়ে যাই।’ জাহানারার প্রশিক্ষণের আজই শেষ দিন। কিছুদিন পরই ড্রাইভিং পরীক্ষা। তাঁকে শুভকামনা জানালাম।
স্কুটি শিখতে স্বামী রাসেলের সঙ্গে এসেছেন সিটি কলেজের অনার্সের শিক্ষার্থী ফারজানা আক্তার। বলছিলেন, টিকটকে মেয়েদের বাইক চালানো দেখে নিজে শেখার ইচ্ছা হয়। স্ত্রী স্কুটি চালাচ্ছেন, ব্যাপারটি নিয়ে স্বামী বেশ উৎসাহী। বলছিলেন, ‘আমরা কয়েক দিন পর বিদেশে চলে যাব। সেখানে বাইক-গাড়ি এসব চালাতে জানাটা খুবই জরুরি। যেহেতু সে বাইকের প্রতি বেশি আগ্রহী, তাই সেটিই আগে শিখছে।’
অনেকেই ভাবেন স্কুটি, মোটরসাইকেল চালাতে হলে আগে সাইকেল চালনা জানতে হয়। ব্যাপারটি এমন না। সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে পাঁচ থেকে ছয় দিনের মধ্যেই শিখে ফেলা যায়, জানালেন নাদিয়া। শেখার জন্য যাঁর যতগুলো ক্লাস প্রয়োজন, তাঁকে সেভাবেই সময় দেওয়া হয়। কোনো ধরাবাঁধা সময় নয়, যে যাঁর সুবিধামতো সময়ে এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে যান। এই প্রশিক্ষণ নিতে জনপ্রতি মাসিক খরচ হবে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতি মাসেই নাদিয়ার কাছে ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী স্কুটি চালনার প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। এতে স্কুটি চালনা শিখিয়েই মাসে তাঁর আয় হয় লাখখানেক টাকা।