‘অধুনা’র আইনি পরামর্শ কলামের সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঠকদের প্রশ্ন আমার কাছে আসে। ২০২৩ সালে আমার কাছে যেসব পাঠক আইনি পরামর্শ চেয়েছেন, তার বেশির ভাগই ছিল পারিবারিক আইন ও সাইবার অপরাধসংক্রান্ত।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত বাড়ছে ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ সব মাধ্যমে অনলাইন ইউজারদের নিয়মিত আনাগোনা চলে।
সাইবার স্পেসে আক্রমণের সহজ এক শিকার নারী। স্কুল-কলেজপড়ুয়া কিশোরী, তরুণী থেকে শুরু করে গৃহিণী, পেশাজীবী নারীরাও অনলাইনে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, অসচেতনতার ফলে নানা ধরনের অপরাধ ও প্রতারণার শিকার হন নারী।
অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও শেয়ার করেন তাঁরা। সেই ছবি ব্যবহার করে পরে তাঁর কাছে অর্থ দাবি করা হয়। সমাজ এবং পরিবারের সামনে মানসম্মান হারানোর ভয়ে তিনি অপরাধীকে অর্থের জোগান দিয়ে থাকেন। সচেতনতার অভাবে নারী তাঁর ওপর কোনো আক্রমণ হলে আইনি সহায়তা নেন না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা তাকে বারবার ব্ল্যাকমেল করতে থাকে। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অনেক নারী এসেছেন, যাঁদের মধ্যে আমি আত্মহত্যার প্রবণতা দেখেছি। নারী কখনো সাইবার হয়রানি অথবা বৈষম্যের শিকার হলে কী ধরনের প্রমাণাদি সংরক্ষণ করা উচিত, এ ব্যাপারে তাঁরা জানেন না। ফলে অনেক সময় সাহস করে আইনি পদক্ষেপ নিলেও তা সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে আর টেকে না।
নারীকে অবশ্যই তাঁর অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে। নারীদের সহায়তায় দেশে রয়েছে সাইবার আইন। রাষ্ট্র সাইবার স্পেসে নারীর মুক্ত পদচারণ নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। তাই কেউ যদি আপনাকে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করতে চায়, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৮৩ ধারা অনুযায়ী এ ধরনের ব্ল্যাকমেলকে চাঁদাবাজির আওতায় ফেলা যাবে। ৩৮৪ ধারা অনুযায়ী এর শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড।
ব্ল্যাকমেলিং একটি জঘন্য অপরাধ। দেশের প্রচলিত সব আইন সম্পূর্ণরূপে আপনার পক্ষে। অতি দ্রুত নিকটস্থ থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করুন। প্রয়োজনে জিডির কপি নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হেডকোয়ার্টারে অবস্থিত সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এ ছাড়া দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে পুলিশের ‘হ্যালো সিটি’ অ্যাপের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিল করে প্রতিকার চাইতে পারেন।
পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, বিয়ে যথাযথভাবে রেজিস্ট্রেশন করা হয় না। মুসলিম পারিবারিক আইনে কাবিননামা একটি প্রামাণ্য দলিল। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বিয়ে প্রমাণ করা কঠিন। রেজিস্ট্রেশন করা না থাকলে নারীরা প্রতারিত হতে পারেন। দেনমোহর, ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার নির্ণয়, সন্তানের পিতৃত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা একটি আইনি দলিল। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন না করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনেকেই মা–বাবার অমতে নিজেরা পালিয়ে বিয়ে করেন। এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হলে তা নিয়ে অনেক জটিলতার উদ্ভব হয়। সেটি একটি অনিয়মিত বিয়ে হিসেবে গণ্য হয়। পরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হলে বিয়ে–সম্পর্কিত অধিকার আদায় করা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আইন মেনে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
সরকার তথ্য জানার জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে; কিন্তু তথ্য জানার ক্ষেত্রে অনেকেই অসচেতন। সাধারণ আইনগুলো নাগরিকেরা জানলে কেউ তাঁদের অধিকার খর্ব করতে পারবে না। নিজের আইনি অধিকার সম্পর্কে মানুষ যত বেশি সচেতন হবে, সমাজে অরাজকতা ও নিপীড়ন তত কমে যাবে। একটি সুন্দর রাষ্ট্র গড়তে হলে সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।
নতুন বছর সবার জন্য শুভ হোক, আইনি বিষয়ে সচেতনতা বাড়ুক।