২০১৫ সালের শুরুতে ভারতে ‘জসবীর সিং ও অন্যান্য বনাম পাঞ্জাব রাজ্য মামলা’র রায়ে কারাবন্দীদের নিজ নিজ স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকে (কনজুগাল ভিজিট) অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়, বন্দীদের দাম্পত্য সাক্ষাৎ তাঁদের জন্মদানের অধিকারের (রাইট টু প্রক্রিয়েশন) আওতায় পড়ে। দাম্পত্য সাক্ষাতের উপযুক্ত অবকাঠামো ও নীতিমালা তৈরির জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনাও দেন আদালত। পৃথক একটি মামলায় মাদ্রাজ হাইকোর্ট পরে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক আসামিকে দাম্পত্য সাক্ষাতের সুযোগ করে দেন। রায়ে আদালত বলেন, দাম্পত্য সাক্ষাৎ বিশেষ সুবিধা নয়, অধিকার।
সর্বশেষ খবর, গত ২০ সেপ্টেম্বর ভারতের মধ্যে প্রথম রাজ্য হিসেবে পাঞ্জাব এ সুবিধা চালু করেছে। এ ব্যবস্থায় প্রতি তিন মাস পরপর বন্দী তাঁর সঙ্গীর সঙ্গে কারাগার–সংলগ্ন বিশেষ কেবিনে দুই ঘণ্টার জন্য একান্ত সাক্ষাৎ করতে পারবেন। এ সুবিধা পাওয়ার জন্য বন্দীকে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে, বিয়ের বৈধ কাগজ ও যৌনবাহিত রোগ নেই, এমন সনদ দেখাতে হবে। সবাই এ সুবিধা পাবেনও না। যাঁরা দীর্ঘদিন জেলে আছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণের মতো মারাত্মক অভিযোগ নেই, যাঁরা কারাগারে আচরণবিধি মেনে চলেন, এমন বন্দীদের এ সুযোগ দেওয়া হবে।
দাম্পত্য সাক্ষাৎ নতুন কোনো বিষয় নয়। কানাডা, জার্মানি, রাশিয়া, স্পেন, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, যুক্তরাস্ট্র, ব্রাজিল, ইসরায়েলসহ বিশ্বের অনেক দেশ বন্দীদের এ সুবিধা দিচ্ছে। সৌদি আরব, ওমানসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশেও বন্দীদের জন্য দাম্পত্য সাক্ষাৎ অনুমোদিত। সাধারণত দুইভাবে বন্দীদের এই সাক্ষাতের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
এক. কারাগারের অভ্যন্তরে নিরাপদ কেবিন বা রুমের ব্যবস্থা রাখা, বন্দীর স্ত্রী বা স্বামী সেখানে আসেন এবং কয়েক ঘণ্টা একান্তে কাটান।
দুই. বন্দী প্যারোলে মুক্ত হয়ে নিজের বাড়িতে যান আর কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে কাটান। আসলে বন্দীর অপরাধ ও আচরণ এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়। বন্দী নিরাপদ ও পালানোর আশঙ্কা নেই, এমন মনে হলে প্যারোল দেওয়া হয়ে থাকে।
সুবিধা–অসুবিধা
এ ধরনের সাক্ষাতের সুবিধা–অসুবিধা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। প্রথমে বলি অসুবিধার কথা। প্রভাবশালী ও বিত্তশালী বন্দীরা এমন সুযোগের অপব্যবহার করতে পারেন, যা ভিকটিমদের মনস্তাত্ত্বিক পীড়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে। বাইরে থেকে মাদকের মতো অবৈধ নানা কিছু কারাগারে প্রবেশ করার ঝুঁকিও থাকে। বন্দীরা একটা নিয়ন্ত্রিত পরিমণ্ডলে থাকে, বাইরের কারও সঙ্গে মেশার সুযোগে সে রোগাক্রান্ত হতে পারে। যেহেতু তাঁরা শারীরিকভাবে মিলিত হবে, এখানে গোপনীয়তা রক্ষা করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, চ্যালেঞ্জও। যে অসুবিধাগুলোর কথা এখানে বললাম, তার প্রতিটিই ব্যবস্থাপনার বিষয়, যা উত্তরণ সম্ভব।
স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন, এ ব্যবস্থায় সুবিধা কী? শাস্তির উদ্দেশ্য কিন্তু অপরাধীকে শুধু কষ্ট দেওয়া না, বরং একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সংশোধন করে সমাজে তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা। বন্দী অধিকার সারা বিশ্বে স্বীকৃত। বন্দী অধিকারের মধ্যে দাম্পত্য সাক্ষাতের অধিকারও পড়ে। জীবনের অধিকারের মধ্য জীবন সৃষ্টির অধিকারও (সন্তান নেওয়ার অধিকার) পড়ে। অপরাধ যিনি করলেন, তার কিছু অধিকার রাষ্ট্র কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু অপরাধীর স্ত্রী বা স্বামীর অধিকার তো কেড়ে নিতে পারে না। কেননা তাঁর স্ত্রী বা স্বামী তো আইনত কোনো অপরাধ করেনি। তাঁর তো স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটানোর অধিকার আছে। আর দাম্পত্য অধিকার স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে থাকা, শারীরিকভাবে মিলিত হওয়া, সন্তান ধারণ ও তাঁকে লালনপালনের অধিকার প্রদান করে।
অধিকারকর্মীদের মতে, এমন সুযোগ না থাকার মানে তো অপরাধীর স্ত্রী বা স্বামীকেও এক অর্থে অপরাধের ভিকটিম বানানো। রাষ্ট্র তো তাঁকে অনৈতিক কোনো পথে ঠেলে দিতে পারে না। তাই দাম্পত্য অধিকার চর্চা ও সন্তানধারণের সুযোগ দিতে রাষ্ট্রগুলো বন্দীদের দাম্পত্য সাক্ষাতের সুযোগ দিচ্ছে। এই সুযোগের আওতায় পরিবারের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে পারে বন্দী। তাঁর সঙ্গীর দুঃখ, একাকিত্ব ভাগ করে নিয়ে এই ক্রান্তিকালে একে অপরকে সাহস দিতে পারে, নতুন করে তাঁকে দেখাতে পারে জীবনের স্বপ্ন। দাম্পত্য সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ বন্দীর মানসিক ও শারীরিক যোগাযোগ পুনরায় সমাজ আত্তীকরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ
দাম্পত্য সাক্ষাৎ বিষয়ে আমাদের কোনো আইন নেই। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের কোনো সিদ্ধান্তও দৃষ্টিগোচর হয় না। তবে আমাদের প্যারোল সিস্টেম আছে। সাধারণত নিকটাত্মীয় মারা গেলে বন্দীকে প্যারোল দেওয়া হয়। পরিবারের সঙ্গে বন্দীদের পুনঃযোগাযোগ স্থাপনে প্যারোলকে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমাদের দেশে বহু পুরোনো প্রিজনার অ্যাক্ট ও জেল কোড আধুনিক করার জন্য কাজ চলছে। আগে বন্দীদের মুঠোফোনে কথা বলার অধিকার ছিল না, এখন দেওয়া হচ্ছে। এতে করে বড় কোন অসুবিধা তো সৃষ্টি হয়নি, বরং বন্দীদের সঙ্গে পরিবারের বন্ধন বৃদ্ধি পেয়েছে।
দাম্পত্য সাক্ষাৎ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা দরকার। পাইলট ভিত্তিতে একটি মডেল কারাগারে দাম্পত্য সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় নিয়ে এ বিষয়ে জেল কোডে সুনির্দিষ্ট বিধান সংযুক্ত করার সুযোগ আছে। দাম্পত্য সাক্ষাৎ যেহেতু সর্বজনীন অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত নয়, এখনো গঠনের পর্যায়ে আছে, কল্যাণকামী রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের দেশেও হয়তো একসময় দাম্পত্য সাক্ষাৎ অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: বিচারক, রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনাল