পুরান ঢাকায় ঈদের দিন এখনো দেখা মেলে নাগরদোলা, চরকির
পুরান ঢাকায় ঈদের দিন এখনো দেখা মেলে নাগরদোলা, চরকির

ঈদ স্মৃতি

আমলিগোলায় ঈদ আসত অনেক আনন্দ নিয়ে

আমার জন্ম পুরান ঢাকার আমলিগোলায়। লালবাগের পেছনে দীর্ঘ একটা রাস্তার দুই পাশে আমলিগোলা। শ্রীনাথ স্ট্রিট, আতশখানা লেন, জগন্নাথ সাহা লেন—এমন সব সোনালি নাম ছড়িয়ে আছে এদিক–সেদিক। তবে মানুষের মুখে মুখে আমলিগোলা নামটি আজও অমলিন। এ এলাকার বিখ্যাত এক সমাজসেবক ও ইতিহাসবিদের নাম নাজির হোসেন। তাঁর লেখা কিংবদন্তির ঢাকা বইয়ে আছে, রাস্তার মোড়ে বড় আমলি বা তেঁতুলগাছ ছিল বলে নাম হয়েছে আমলিগোলা। মতান্তরে শায়েস্তা খাঁর আমলে এখানে শস্যের গোলা ছিল। সেই ‘আমির গোলাহ’ থেকে আমলিগোলা।

আমলিগোলার পেছনে বিস্তীর্ণ কামরাঙ্গীরচর। এখন তো বুড়িগঙ্গা অনেক দূর সরে গেছে। ছোটবেলায় দেখেছি, এই চরে ছিল অল্প কিছু বাড়িঘর। বাঁশের বেড়া বা টিনের তৈরি। বর্ষাকালে পুরো চর ডুবে যেত। কখনো কখনো আমলিগোলার রাস্তায়ও উঠে আসত পানি। গলিতে তখন নৌকা চলতেও দেখেছি।

শীতকালে কামরাঙ্গীরচর হয়ে উঠত ফসলের খেত। আমাদের বাসায় কাজ করত এক মেয়ে, নাম আনোয়ারা। সে থাকত কামরাঙ্গীরচরে। শীতের বিকেলে সে আমাদের ঘোরাতে নিয়ে যেত চরের মাঠে। চরের পাশে ছিল বালুঘাট, কয়লাঘাট। বড় বড় মহাজনি নাও এসে ভিড়ত আমলিগোলার বিভিন্ন ঘাটে। ছেলেবেলায় বালুঘাটের শস্য তোলা ন্যাড়া মাঠে খেলাধুলা করেছি আমরা। বিকেলে হাওয়া খেতে ঘুরে বেড়িয়েছি। কোনো কোনো দিন হেঁটে হেঁটে খররোদে চর পেরিয়ে চলে গেছি বুড়িগঙ্গায়। দুপুরে নদীর পানিতে লাফ–ঝাঁপ দিয়েছি, সাঁতার কেটেছি। নদীর ওপারে আটি, কেরানীগঞ্জ—এমন সব নামের গ্রাম। সেসব গ্রামের চিহ্নও আজ নেই। কামরাঙ্গীরচরে এখন ঘনবসতি; বড় বড় দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, বাজার। ছেলেবেলাকে চিনতে পারার সামান্য উপকরণ সেই চরে নেই!

ঢাকার ঈদ জামাত

প্রিয় আমলিগোলাতেও এখন অল্প পরিসরে উঁচু উঁচু দালানকোঠা। জনবৃদ্ধির চাপ। আজকাল আমলিগোলাকে চেনা যায় না। এ পাড়ায় বড় বড় উঠান দেখেছি। গাছপালা দেখেছি নানা রকম। নিরিবিলি মফস্সল শহরের ছায়া ছিল আমলিগোলায়। স্থানীয় লোকেরা নানা রকম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কেউ চকবাজারে, কেউ নওয়াবপুরে দোকানদারি করতেন। লালবাগ, আমলিগোলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল অনেক ছোটখাটো দোকান, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আমলিগোলায় থাকতেন আনোয়ার হোসেন, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা; বাংলাদেশের আদি শিল্পপতিদের একজন।

ছোটবেলায় আমলিগোলায় মহিষের শিংয়ের কারবারিদের দেখেছি। ছোট্ট একটা ঘরে মহিষের শিং পুড়িয়ে চিরুনি ও অন্যান্য শৌখিন জিনিসপত্র বানাতেন তাঁরা। শিং পুড়িয়ে নরম করা হতো। তারপর ঘষে ঘষে বাড়ানো হতো উজ্জ্বলতা। ছুরি দিয়ে কেটে কেটে তৈরি করা হতো চিরুনির খাঁজ। এমন একজন কারিগর ছিলেন টাপ্পুর বাবা। রোগা–পাতলা মানুষ। পরনে থাকত স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি।

দুই

সেই চঞ্চল বনেদিপাড়া আমলিগোলায় ঈদ আসত অনেক আনন্দ নিয়ে। পুরো এক মাস রোজা। পুরান ঢাকার মানুষ রোজায় দোকানের খাবার খেতে খুব ভালোবাসে। তাই ধীরে ধীরে চকের ইফতারির বাজার গড়ে উঠল। রোজার দিনে লালবাগ চৌরাস্তার মোড় ও আমলিগোলায় দুপুর থেকেই জমে উঠত ইফতারির বাজার। খুব প্রিয় ছিল ঘুগনি আর তেহারি। পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, ছোলা, শর্ষের তেল মাখিয়ে বড় গামলায় বানানো হতো মুড়িভর্তা। দলেবলে মুড়িভর্তা খাওয়ার মজাই আলাদা।

শেষ রাতে সাহরির সময় এলাকার তরুণেরা কাসিদা গেয়ে ঘুম ভাঙাতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে দল বেঁধে গান গাইতেন সমস্বরে। রোজা শেষে কাসিদা গাওয়ার দলকে দেওয়া হতো বকশিশ। আমলিগোলার আফসু, ইকবাল, আসলাম সানী রমজান মাসে বহুদিন কাসিদা গেয়েছেন। শুরুতে ছড়াকার আসলাম সানীর কাছে নিতে হতো কাসিদার তালিম।

১৯৭১ সালে ঢাকায় ঈদের নামাজের পর কোলাকুলি

তখন ঈদের জামাকাপড় রেডিমেড কেনা হতো না। টেইলার্সে যাঁরা কাপড় সেলাই করতেন, তাঁদের বলা হতো ‘খলিফা’। সত্তরের দশকে ঈদে একবার খলিফা সাহেব আমার একটা চেক শার্ট আকারে ছোট করে ফেলেছিলেন বলে বাবার সে কী উত্তেজনা! বাবা তখন শাড়ি কিনতে যেতেন সদরঘাটে। ঢাকায় তখন বিপণিবিতানগুলোর এমন রমরমা অবস্থা ছিল না। সদরঘাটের পরে বায়তুল মোকাররম মার্কেট গড়ে উঠল। নিউমার্কেট, গাউছিয়ায় শাড়ি–কাপড় বিক্রি শুরু হয় আরও পরে। নিউমার্কেটে তখন কাঁচাবাজার ছিল জমজমাট। বাবার সঙ্গে ঈদের আগের দিন আমরা নিউমার্কেট কাঁচাবাজারে যেতাম। উঁচু টিনশেডের ঢাকনা দেওয়া মার্কেট। বাবা ঘুরে ঘুরে দরদাম করে জিনিসপত্র কিনতেন। চিনি, পোলাওয়ের চাল, বুটের ডাল, দুধ, সেমাই, লাচ্ছা, গরুর মাংস, মুরগি—কাপড়ের ব্যাগে এসব সদাইপাতি নিয়ে বাবার সঙ্গে বাসায় ফিরতাম রিকশায় চেপে।

সদরঘাটে টিনশেডের মার্কেটে নানা রকম শাড়ি পাওয়া যেত। সে আমলে ক্যারোলিন শাড়ি খুব জনপ্রিয় ছিল। পাতলা সিল্কের মতো শাড়ি। মা, ফুফু ও চাচির জন্য তিনটা শাড়ি বাবাকে কিনতেই হতো। আমলিগোলা থেকে রিকশায় চেপে যানজটহীন শহরে খুব দ্রুত সদরঘাটে পৌঁছে যেতাম। লালবাগ হয়ে চকবাজার, মোগলটুলী পেরিয়ে বাবুবাজার, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী হয়ে চলে যেতাম সদরঘাটে। এই ব্যস্ততম রাস্তাটুকু রিকশায় যেতে ভারি ভালো লাগত। বাবা দেখিয়ে দিতেন, এটা জেলখানা, ওই যে আহসান মঞ্জিল, ওপাশে বুড়িগঙ্গা নদী এবং ওদিকে ধোলাইখাল, এককালে সেখানে নৌকা চলত। বাঁ পাশে নওয়াবপুর। পেরিয়ে এলাম তাঁতিবাজার। এই যে জজকোর্ট, জগন্নাথ কলেজ। বাঁ পাশে চলে গেলে বাংলাবাজার, ওখানে বইয়ের আড়ত। বাবা এভাবে আমাদের ছোটবেলায় ঢাকা শহর চিনিয়ে দিয়েছিলেন। ছোটবেলাতেই শহীদ মিনার, হাইকোর্ট, কার্জন হল, ডিআইটি—এসব চিনে ফেলেছিলাম।

তিন

১৯৭১ সাল। আমলিগোলায় এসে লাগে যুদ্ধের ঢেউ। এলাকার মোশাররফ ভাই, সোহান ভাই বুড়িগঙ্গার ওপারে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন বলে। আর যাঁরা প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন, সরাসরি যাঁরা পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা রইলেন নিশ্চুপ। এলাকার শান্তিরক্ষার জন্য তাঁরা তৎপর। তাই আমলিগোলায় যুদ্ধের ডামাডোল তেমন চোখে পড়েনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমলিগোলায় আসেনি। এ এলাকায় আইয়ুব খানের দালালেরা খুব সক্রিয় ছিল। তারা মনেপ্রাণে পাকিস্তানের ভাঙন চায়নি। যাহোক, একাত্তরে ঈদুল ফিতর এসেছিল সম্ভবত ডিসেম্বর মাসে। আকাশে একফালি শাওয়াল মাসের চাঁদ উঠেছিল। পরদিন ঈদের নামাজ হয়েছিল মসজিদে। আমলিগোলার সরু রাস্তায় সার বেঁধে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ঈদে আমরা নতুন জামাকাপড় পরিনি। বড় ভাইয়ের টাইট হয়ে যাওয়া জামা পরেই চালিয়ে দিয়েছি আমি। একটা কতবেল কিনে লাঠি দিয়ে ঘুঁটে ঘুঁটে খেয়েছি সারা দিন। কী যে সুস্বাদু ছিল সেই কতবেল!

মা রান্না করেছিলেন সাদা পোলাও, আলু দিয়ে গরুর টকটকে লাল মাংস, সেমাই আর গুড়ের ক্ষীর। অভাবের সংসারে খাবারের প্রাচুর্য ছিল না। আমরা খিদে পেটে ইঁদুরের মতো ছটফট করতাম। মা ঠিকই টের পেতেন। যৎসামান্য যা জুটত, খেতে দিতেন। স্বাধীনতার পরও আমার বাবার ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না। আরও অভাব এসে গ্রাস করল দানবের মতো। সে সময় রিলিফের একটা শার্ট পেয়েছিলাম। চকরাবকরা নকশা। কি শীত, কি গ্রীষ্ম—সেই শার্ট পরে থাকতাম দিনমান।

একাত্তরে ঈদ জামাত

তখন নতুন বছরে নতুন বই কেনার সামর্থ্যও আমাদের ছিল না। বড় ভাইয়ের পুরোনো বই মোটা সুতা দিয়ে সেলাই করে ভালো ছাত্র হওয়ার চেষ্টা করতাম। আমাদের কালে লোকদেখানো ব্যাপারটা কম ছিল। মানুষ ছিল সহানুভূতিশীল। ধনী–গরিবে এত ফারাক দেখিনি। পুরান ঢাকার পাড়া–মহল্লায় সবাই এক পরিবারের অংশ হিসেবে বাস করত।

তাই আক্ষরিক অর্থে বলা যায়, সেকালে ঈদের দিনে সবার দুয়ার থাকত খোলা। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ি যেত নির্দ্বিধায়। উঠানে কোনো সীমানাপ্রাচীর ছিল না। মেয়েরা সেজেগুজে দল বেঁধে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যেত। বোনদের হাতের আঙুল ধরে ঘুরে বেড়াত ছোট ভাইয়েরা।

ঈদে জমজমাট মেলাও বসত। কামরাঙ্গীরচরে এমন একটা ঈদ মেলা বসত ঈদের পরদিন। চারপাশে চারটা নাগরদোলা ঘুরত। ওতে চড়তে খুব ভালোবাসতাম। ক্যাড়ক্যাড় শব্দ শুনলেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠত। মেলা থেকে একবার একটা কাগজের কুমির কিনেছিলাম। সুতা ধরে টানলে কুমিরটা ফরফর করে এগোত। কুমিরের দাম ছিল মাত্র দুই আনা, অর্থাৎ ১২ পয়সা। একবার বাবার সঙ্গে সেই মেলায় গিয়ে হারিয়েও গিয়েছিলাম! ছেলেবেলার সেই ঈদ হারিয়ে গেছে, কাগজের কুমির হারিয়ে গেছে। ছেলেবেলায় ঈদের আনন্দ হতো ষোলো আনা। জীবন ছিল রৌদ্রছায়ায় মমতাময়।