মেয়েদের প্রতি কেন এত বিদ্বেষ!

লিঙ্গ সমতার প্রশ্নে নারীদের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা তাদের ওপর মানসিক চাপ বাড়ায়। মডেল: নাবিলা
কবির হোসেন

মা চাকরি করলে সন্তানের দুর্ভোগ হয়। দেশে ৮৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ এমনটা মনে করেন। ইউনেসকো তাদের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনটির ফল নিয়ে গত ২২ জুলাই আমার একটা লেখা প্রকাশ করে প্রথম আলো। সেটি অনলাইনে প্রকাশের পর নিচে অনেকেই মন্তব্য করেন। তার থেকে কয়েকটা তুলে ধরতে চাই।

লেখাটাকে একজন উসকানিমূলক উল্লেখ করে বলেছেন, ‘যার চাকরি লাগবে সে করবে, যারা পাবে না সে করবে না, সে পুরুষ হোক বা নারী, তবে উসকানিমূলক বা খোঁচা মারামূলক কথাবার্তা বলার কী দরকার? পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে, যাদের কাছে টাকাই ভগবান, লেখিকা এর বাইরে নয়। আর এদের সন্তান নেওয়ার কী দরকার?’

আরেকজন লিখেছেন, ‘নিজেদের একবার সেইসব বাচ্চাদের জায়গায় রাখুন এবং ভাবুন যে, আপনার মা–বাবা আপনাকে বুয়ার কাছে রেখে ৮-১০ ঘণ্টার জন্য অফিসে গেছে। দেখুন কেমন লাগে। যদি ভালো লাগে তাহলে আপনিও আপনার সন্তানদের সঙ্গে এমনই করুন।’

আরেক মন্তব্যকারী পশ্চিমাদের ‘সবকিছু’ অনুসরণ না করার পরামর্শ দিয়ে লিখছেন, ‘...দুজন একসঙ্গে চাকরি করার ফলে বাচ্চাদের কী অবস্থা হচ্ছে সেটা আমাদের আশেপাশে চোখ বুলালেই দেখতে পাবেন।’

আমি সাংবাদিক, তাই হয়তো সংবাদবিষয়ক বিরূপ মন্তব্য দ্রুত হজম করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। আমরা সহকর্মীরা মাঝেমধ্যে এ নিয়ে আলোচনা করি। অনেক সময় প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার আগে আগে আমরা বলি, ‘আজ কয়টা গালি খাব কে জানে!’ বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে যতবার প্রতিবেদন লিখি, ততবারই আগাম বুঝতে পারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাবে। মন্তব্য যা আসবে, তাতে যুক্তির চেয়ে খিস্তিখেউর থাকবে বেশি। মন্তব্যকারীদের বেশির ভাগই মত প্রকাশ করেন যে বাল্যবিবাহ ছেলেমেয়েদের ‘অবৈধ সম্পর্ক’, ‘গর্ভপাত’ ঠেকায়। তবে এটাও ঠিক, যাঁরা বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রয়েছেন, বিদ্রূপের শিকার হওয়ার ভয়ে তাঁরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ফলে শুধু এক পক্ষের মন্তব্য থেকে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না, একটা ধারণা পাওয়া যায় মাত্র।

ছোট শিশুরাও রক্ষা পায় না

সংবাদের প্রয়োজনে বেশিসংখ্যক মানুষকে জানতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে থাকি। তেমন একটি গ্রুপে একবার এক মা পাঁচ বছরের মেয়েকে পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরিয়ে ছবি পোস্ট করেছিলেন। ওই মা নিজেও পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরেন। ওই ছবি দেওয়ার পর ‘এই বয়স থেকে এমন পোশাক পরালে শালীন পোশাক পরা শিখবে না’, ‘যেমন মা, তেমনভাবে মেয়েকে বড় করছে’ ইত্যাদি কয়েক শ মন্তব্য আসার পর ওই মা লিখেছিলেন তিনি অসুস্থ বোধ করছেন, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকেই মেয়েটির মায়ের পক্ষে বলেছেন, তবে সেসব মন্তব্য তাঁকে সাহস জুগিয়েছে কি না, জানি না!

সামাজিক মাধ্যমে শিশুর ছবি বা ভিডিওতে অনেকে খারাপ মন্তব্য করেন

এসব তো গেল অনলাইন মন্তব্য। অফলাইন বা সরাসরি মন্তব্য এর চেয়ে কম হয় না। এক মা একবার বলছিলেন, তাঁর আট বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে বাসার কাছে পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলেন শিশুটির বাবা। মেয়েটির স্বাস্থ্য ভালো। পার্কে গিয়েছিল ফ্রক পরে। বাবার হাত ধরে হাঁটার সময় দুজন নারী পাশ দিয়ে যেতে যেতে তির্যক দৃষ্টিতে তাকান। এরপর দুই নারী বলতে থাকেন, ‘মেয়ের গায়ে একটা ওড়না দিয়ে নিয়ে আসতে পারল না!’ মেয়েটি শিশু, তাই নিজে কিছু বুঝল না, বাবা সবই বুঝলেন। বেড়ানোর ইচ্ছা মাঝপথে চাপা দিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। বিষণ্ন কণ্ঠে স্ত্রীকে ঘটনাটি জানালেন।

আগে-পরের গবেষণা, ফলাফল হতাশাজনক

এবার ইউনেসকোর প্রতিবেদনটির বিষয়ে ফিরে আসি। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বৈশ্বিক শিক্ষা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন ২০২২–এ ‘ওয়ার্ল্ড ভ্যালুজ সার্ভে’-তে ৮৪টি দেশের ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে। সেখানে বলা হয়, বিশ্বের ৪৩ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ মনে করেন, মা ঘরের বাইরে কাজ করলে সন্তানের দুর্ভোগ হয়। ওই প্রতিবেদনে নারীর শিক্ষা, আয়, আচরণ নিয়েও সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের কথা ছিল। সেসব মনোভাবে অসম বিশ্বের চিত্রটিই উঠে এসেছে। এ বছরের জুলাই মাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক জেন্ডারবৈষম্যবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে পূর্ণ সমতা অর্জনে লাগবে ১৩২ বছর।

ওই প্রতিবেদনের গবেষণার বেশ পরে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দুই ধাপে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণদের ওপর একটি জরিপ করে। জরিপে অংশ নেন আট জেলার প্রায় তিন হাজার নারী-পুরুষ। গত ১০ অক্টোবর ‘বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জেন্ডার আচরণগত মনোভাব অন্বেষণ’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ যুব নারী-পুরুষ জেন্ডার সমতার বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন।

যেমন পোশাক ধর্ষণের কারণ হতে পারে না। তাহলে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হতো না। অথচ গবেষণায় উঠে আসে যে পোশাকের কারণে নারীরা ধর্ষণ ও যৌন হেনস্তার শিকার হন, মনে করেন ৬৩ শতাংশ যুব নারী-পুরুষ। ৮২ শতাংশ মনে করেন, নারীদের জোরে কথা বলা উচিত নয়। স্বামীর উপার্জন যথেষ্ট হলে নারীর আয় করার প্রয়োজন নেই, মনে করেন ৭৫ শতাংশ। সংসারের ব্যয়ের বিষয়ে পুরুষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, মনে করেন ৭১ শতাংশ। যুবদের ৭৭ শতাংশ মনে করেন, রাগ শুধু ছেলেদের থাকবে। ৪৯ শতাংশ মনে করেন, নারীরা যৌন আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি প্রকাশ করতে চান না, তাই ছেলেদের জোর করা উচিত। ৫১ শতাংশ মনে করেন, নারীর চেয়ে পুরুষের চাকরিতে অধিকার বেশি থাকা উচিত। নারী-পুরুষের মধ্যে ঋণ যিনিই পান, সেই টাকা খরচে পুরুষের কথাই চূড়ান্ত, মনে করেন ৬৮ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহ্জাবীন হকের নেতৃত্বে গবেষণা দলে আরও ছিলেন একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম ও ন্যাশনাল একাডেমি ফর নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটির সহকারী অধ্যাপক (মনোবিজ্ঞান) সেলিম চৌধুরী।

জানা গেছে, ওই গবেষণায় অনেক প্রশ্নের সঙ্গে একটি কৌশলী প্রশ্নও ছিল, ‘আপনার বোনকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে দেবেন কি না?’ প্রত্যেকেই না সূচক জবাব দিয়েছেন।

পরিবার-সমাজে সমতা জরুরি

ব্র্যাকের ওই গবেষণার জন্য মনোবিজ্ঞানী সেলিম চৌধুরী বগুড়ার কয়েকটি উপজেলায় যুব নারী-পুরষদের সাক্ষাৎকার নেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, নেতিবাচক মনোভাব বেশি আসার বিষয়টি উদ্বেগজনক। একজন ছোটবেলা থেকে যা শেখেন, পরবর্তী জীবনে তা প্রতিফলিত হয়। একজন তরুণ তাঁর জীবনের পরবর্তী ধাপ পর্যন্ত নেতিবাচক মনোভাব বয়ে বেড়াতে পারেন। আবার সুশিক্ষা নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা গড়ে তুলতে পারেন। এসবের ওপর ঠিক হবে তাঁর পরবর্তী জীবনের দিকনির্দেশনা। দেশের জনসংখ্যার বেশির ভাগ তরুণ। তাই সেই দিকনির্দেশনা থেকে বোঝা যাবে, কাদের হাতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব যাবে। আরেক দল আছেন, মনে নারীর প্রতি বিদ্বেষ পোষেন, কিন্তু মুখে প্রকাশ করেন না।

প্রতিকার কী হতে পারে জানতে চাইলে সেলিম চৌধুরী বলেন, পরিবার থেকে সমতার শিক্ষা দিতে হবে। দেশে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় কাঠমোতে নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে। এ কাঠামোগুলো অনেক সময় শেখায় ক্ষমতাবান হতে হবে, অন্যদের আটকে হলেও নিজেকে বড় হতে হবে। এ ধরনের মনোভাব নারীর প্রতি অশ্রদ্ধা শেখায়। তাই জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠায় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে।