ছোটবেলা থেকেই লোকগানের প্রতি ঝোঁক। গ্রামে কীর্তনের আসর বসত, সেখানে গিয়ে কীর্তন শুনতেন। আশপাশে, রাস্তায়, কারও গলায় লালনের গান শুনলেই দাঁড়িয়ে যেতেন। মন দিয়ে শুনতেন। বাসায় এসে গাওয়ার চেষ্টা করতেন। এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলার ঝুপড়ি কিংবা গোলচত্বরে, বিকেল কিংবা সন্ধ্যার নিয়ন আলোয় বসে একমনে গান করেন অর্ণব ভট্টাচার্য। তাঁর সঙ্গে জুটে যান গানপাগল আরও জনা দশেক শিক্ষার্থী। সবাই মিলে মাতিয়ে রাখেন ক্যাম্পাস।
গানপাগল এই তরুণের পাঠ্যও এখন সংগীত। সংগীত বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র তিনি। সংগীতের প্রতি ভালো লাগা থেকেই এ বিভাগে ভর্তি হওয়া। অর্ণব জানান, ছোটবেলায় লোকগান শুনে শুনে সংগীতের প্রেমে পড়েছিলেন ঠিকই, তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের গানের প্রতিই তৈরি হয় টান। স্কুলজীবনে রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীতে ডুবে থাকতেন। কানে হেডফোন গুঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শুনতেন আর গলায় তোলার চেষ্টা করতেন। কলেজজীবনে এসে বাংলা ব্যান্ডের সঙ্গে টুকটাক পরিচয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেশ-বিদেশের নানা ব্যান্ডের সঙ্গে পরিচিত হন অর্ণব। বিটলস, কুইন থেকে শুরু করে লিওনার্ড কোহেন কিংবা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ একেবারে হৃদয়ে গেঁথে যায়। এদের গান, সুর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনতে থাকেন তিনি। এভাবেই ধ্রুপদি, রক, বাউল প্রভৃতি নানা ধাঁচের সংগীতেরই তিনি প্রেমে পড়ে যান। আর এখন শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিচ্ছেন অর্ণব ভট্টাচার্য। অর্ণব বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এসে সংগীতজীবনটা পূর্ণ হয়েছে। নানা ধাঁচ আর শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। প্রথম বর্ষ থেকে সহজিয়া, মেঘদল কিংবা ওয়ারফেজ, আর্টসেলের গান শোনা শুরু। স্কুল কিংবা কলেজজীবনে এসব ব্যান্ডের গান শোনা হয়নি। কারণ, গ্রামে লোকগানের চল ছিল বেশি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সঙ্গে জুটে যান আরও কজন। সবাই মিলে ‘সরলা’ নামের একটা গানের দল করেন। দলটি এখন ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরের নানা অনুষ্ঠানে গান করে। মূলত বাউল ও লোক ঘরানার গানই পরিবেশন করে সরলা। কারণ, লোকগান বা বাউল ঘরানার গানই তাদের বেশি টানে। ইতিমধ্যে ডজনখানেক অনুষ্ঠানে তাঁরা অংশ নিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার সাতমোড়া গ্রামে অর্ণবের বাড়ি। তাঁরা দুই ভাই–বোন। ছোট বোন ফাল্গুনী ভট্টাচার্যও এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। অর্ণব যে শুধু গাইতেই পছন্দ করেন তা কিন্তু নয়, পাশাপাশি সুর করেন, লেখেন। লেখালেখি আর সুর করার ক্ষেত্রে নানাজন তাঁর জীবনে প্রভাব ফেলেছেন। অর্ণব বলেন, ‘লোকসংগীতে কিরণচন্দ্র রায়, রবীন্দ্রসংগীতে জয়তী চক্রবর্তী, ধ্রুপদিতে রশিদ খাঁ, নজরুলসংগীতে তুষার দত্ত আমাকে দারুণভাবে টানে। অন্যদিকে শায়ান চৌধুরী অর্ণবের গানের ভেতর প্রাণ খুঁজে পাই। নিজেকে খুঁজে পাই। প্রিন্স মাহমুদের লিরিকস আমাকে ধরে রাখে।’
নিজের মতো করে গান গাওয়ার চেষ্টা করেন অর্ণব। গত বছর করোনাকালে ‘সব থেমে গেছে’ শিরোনামে একটা গান তৈরি করেন। এটি ফেসবুক প্রোফাইলে আপলোড করা হয়। গানটি ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। কয়েক সপ্তাহ আগে শাটল ট্রেনে তাঁদের গাওয়া একটা লোকগানও ভাইরাল হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো প্রাক্তন শিক্ষার্থী স্মৃতিকাতর হয়ে গানটি শেয়ার করেন। এ সবকিছুই অর্ণবকে প্রেরণা জোগায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে সংগীতের ওপর আরও ডিগ্রি নিতে চান। লোকসংগীতের ওপর পিএইচডি করারও ইচ্ছা আছে তাঁর। পাশাপাশি গান লেখা ও সুর করার কাজটিও চালিয়ে যাবেন। সরলা ব্যান্ডটিকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
শেষ করি অর্ণবের লেখা গানের একটা অংশ দিয়ে, যেটি গত বছর বেশ প্রশংসা পেয়েছিল।
‘আমি জোয়ার–ভাটায় ভাসতে থাকা/শূন্য তরি
আমার নোঙর তো নেই, মাঝিও নেই/ভয়ে মরি।
সব অবাধ্য ঢেউ, আছড়ে পড়ে/আমার ভেলায়
সব থেমে গেছে, হারিয়ে গেছে/অবহেলায়।’