রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত এই শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর চাচাতো ভাই রুহুল আমীন
আবু সাঈদ আমার জেঠাতো ভাই। আমি ওর চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। তবে বড় হলেও একসঙ্গেই আমাদের বেড়ে ওঠা। পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমাদের দুজনের বাবাই বর্গাচাষি। ছোটবেলায় দেখতাম, বাবা–জেঠারা অন্যের জমি চাষ করে যে ফসল পেতেন, তার বড় একটা অংশ সার-বীজ কিনে আর জমির মালিকের ভাগ দিতে দিতেই চলে যেত। এ জন্য প্রায় সময়ই তাঁদের দিনমজুরি খাটতে হতো। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আমি আর সাঈদও দিনের পর দিন মাঠে কাজ করেছি।
ভোরে উঠেই খেতে চলে যেতাম আমরা, সকাল নয়টা পর্যন্ত কাজ করে বাড়ি ফিরতাম। ঘরে যা জুটত, তা-ই মুখে দিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে ফিরে আবার খেতের কাজে লেগে পড়তাম। খেতে কাজের কারণে আমরা বেশি খেলাধুলার সময়ও পেতাম না। এক পোশাকে দু–তিন বছরও পার করেছি।
সেই শৈশব থেকেই জানতাম, আমাদের ভাগ্য বদলের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। খেয়ে না-খেয়ে হলেও পড়াশোনা করতে হবে, ভালো চাকরি করতে হবে, পরিবারের হাল ধরতে হবে।
আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুল থেকেই পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পায় সাঈদ। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর গ্রামেই একটি টিউশনি জোগাড় করে। টিউশনির ১০০ টাকা আর ওই বৃত্তির টাকা দিয়েই খাতা-কলম কিনত, পরীক্ষার ফি দিত। আমার বড় ভাই তত দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। ভাই বাড়িতে এলেই বইখাতা নিয়ে তার কাছে বসে পড়ত সাঈদ। ইংরেজি পড়ত। অনেক সময় তার পাশে আমিও বসে যেতাম।
এসএসসি পাসের পর সাঈদ যখন রংপুর সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়, আমি তখন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ি। সাঈদকে শহরের একটি মেসে তুলে দিই। একসময় অর্থের অভাবে ওর পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলে অনেক কষ্টে একটা টিউশনির ব্যবস্থা করি। সেই টিউশনির টাকায় নিজের ব্যয়ভার মেটানোর পাশাপাশি মা-বাবাকেও সহযোগিতা করতে থাকে সাঈদ।
পড়াশোনা বাদ দিয়ে চলে গেল গ্রামে
সাঈদের প্রতি ওর পরিবারের প্রত্যাশা কতটুকু, আমি জানতাম। ওরা ৯ ভাইবোন। অভাবের কারণে বড় চার ভাইবোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ও পার করতে পারেনি। সাঈদের পিঠাপিঠি ভাই আবু হোসেন এইচএসসি পাস করে পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। তাই আবু সাঈদকে ঘিরেই ছিল পরিবারের সবার আশা–ভরসা। সাঈদও তাদের মান রাখতে চেষ্টা করে যেতে থাকে। ছোট বোন সুমিকে পড়াশোনা করাতে এগিয়ে আসে।
এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকে আবু সাঈদ। আমার কাছে এসে কথায় কথায় বলত, ভাই, আমরা গরিব মানুষের ছেলেপুলে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। কিন্তু বিধিবাম। প্রথমবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ওর সুযোগ হলো না। ভেঙে পড়ল সাঈদ। রংপুর ছেড়ে গ্রামে চলে গেল। খেতখামারে কাজ করতে থাকল। সিদ্ধান্ত নিল আর পড়াশোনা করবে না।
একদিন গ্রামে গিয়ে ওর সঙ্গে বসলাম। দীর্ঘ সময় ধরে বোঝালাম। দ্বিতীয়বার ভর্তি প্রস্তুতি নিতে বললাম। নিজের ওপর নিজের চাপা ক্ষোভ গলতে থাকল। কোচিং করার টাকা নেই। বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু করল।
এবার আর ব্যর্থ হলো না সাঈদ। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেল। বেছে নিল বাড়ির কাছের রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। কাকতালীয়ভাবে আমার ইংরেজি বিভাগেই ভর্তি হলো। ভর্তির দিন সাঈদকে সঙ্গে করে ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলাম। সব দাপ্তরিক কাজ শেষ করে দুজনে আমার মেসে এলাম।
পরের চারটি বছর সাঈদ আমার মেসেই ছিল। সাঈদের সঙ্গে আমার ছয় সেমিস্টারের পার্থক্য। এ জন্য অনার্সের কোনো বই তাকে কিনতে হয়নি। আমার বইগুলো নিয়েই পড়াশোনা করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সাঈদের স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হবে। সেই লক্ষ্য নিয়েই পড়াশোনা করেছে। ক্লাস, নিজের পড়াশোনা আর টিউশনি ছাড়া অন্য কোনো জীবন আমাদের ছিল না। অনেক রাত পর্যন্তও মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াতাম।
ভাই থাকেন, আমি যাচ্ছি
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে তাতে জড়িয়ে পড়ে সাঈদ। কয়েক দিন পরে জানতে পারি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সে-ই অন্যতম সমন্বয়ক। যে রাতে দেশের সব ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে ওঠে, সেই রাতে ওদের সঙ্গে আমিও মিছিলে ছিলাম। রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত মিছিল করলাম। তখন ইউরো কাপের ফাইনাল চলছিল, সেই ম্যাচও দেখলাম।
পরদিন আমাদের মেসে ‘ফিস্ট (ভোজ)’ ছিল। সপ্তাহের এই একটা দিন আমরা ভালোমন্দ খাই। কাকতালীয়ভাবে এবার বাজারের দায়িত্বে ছিল সাঈদ। কিন্তু সে এসে আমাকে বলল, ভাই, আপনি একটু ম্যানেজ করে নেন। আমি আরও তিনজনকে নিয়ে গিয়ে বাজার করে আনলাম। সাঈদ ওর এক বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাল, সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করলাম।
১৬ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে মেস থেকে বের হয় সাঈদ। যাওয়ার সময় বলল, ‘ভাই থাকেন, আমি যাচ্ছি।’ আর জানাল, বেলা তিনটায় ওদের মিছিল, চাইলে আমিও শরিক হতে পারি। তারপর আমিও কাজে বেরিয়ে পড়ি। বেলা ৩টা ২০ মিনিটে খবর পাই, পার্কের মোড়ের অবস্থা খারাপ। আমার ভাইটা গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
ছুটে যাই হাসপাতালে। মর্গে ঢুকে দেখি, আমার ভাইয়ের নিথর দেহ পড়ে আছে। সাঈদের গায়ের টি–শার্ট কেটে খুলে ফেলল একজন। ছেলেটার গায়ের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, নিজেকে সামলে নিয়ে মর্গ থেকে বের হয়ে আসি।
পরের সময়টুকু দুঃস্বপ্নের মতো। আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে গভীর রাতে সাঈদকে নিয়ে আমরা বাবনপুরের পথ ধরি। বিশাল গাড়িবহরের সঙ্গে যেতে যেতে মনে হলো, ছেলেটার কীভাবে বাড়ি ফেরার কথা ছিল আর কীভাবে ফিরছে। কথাটা ভাবতেই শরীরটা শিউরে উঠল, বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেল। (অনুলিখিত)