সুবোধ আমাদের একমাত্র সন্তান। দেড় বছর বয়স থেকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে (ডে–কেয়ার) বেড়ে উঠছে সুবোধ। আমি একটি সংবাদমাধ্যমে চাকরি করি। আর সুবোধের মা জান্নাতুন নাঈম ব্যাংক কর্মকর্তা। ঢাকায় সুবোধকে নিয়ে আমাদের সংসার।
এই শহরের অনেক কর্মজীবী দম্পতি শিশুসন্তানের দেখভালের জন্য বাসায় সহকারী রাখেন। শুরুতে আমরাও একজনকে রেখেছিলাম। তবে মাস দেড়েকের বেশি উনি থাকেননি। চাকরিসূত্রে মগবাজারে ভাড়া বাসায় থাকতাম। সহকারী হঠাৎ চলে যাওয়ায় আমাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। আমরা ছাড়া সুবোধকে দেখভালের মতো বাসায় কেউ ছিল না। দেড় বছরের শিশুসন্তানকে কোথায় রাখব! কঠিন সময়ের মুখোমুখি হলাম। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।
তখন আমাদের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। প্রথমত, দুজনের মধ্যে একজনের চাকরি ছেড়ে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, সুবোধকে কোনো একটা দিবাযত্ন কেন্দ্রে রাখা।
এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
যদিও দিবাযত্ন কেন্দ্র নিয়ে আমাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। নব্বইয়ে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মিলেনিয়াল প্রজন্মের আরও অনেকের মতো আমরাও একান্নবর্তী পরিবারে বড় হয়েছি। শহরে নয়, গ্রামে-মফস্সলে।
মা-বাবার কোলে-পিঠে ও বাড়ির আঙিনায় গড়াগড়ি খেয়ে বেড়ে উঠেছি। ফলে আমাদের সন্তান দিবাযত্ন কেন্দ্রে বেড়ে উঠবে, শুরুতে এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। বাবা হিসেবে মনের গহিনে এক ধরনের খচখচানি ছিল।
তবে এটাও সত্য, দুনিয়ার শৈশবও বদলে গেছে। মিলেনিয়াল শৈশব আর আলফা প্রজন্মের শৈশবে যোজন যোজন ব্যবধান। আমাদের ও সুবোধের শৈশব নয়। এটাই বাস্তবতা। ঠাসা আবেগের ভিড়ে বাস্তবতা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত সুবোধকে ডে–কেয়ারে রাখার সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছিলাম।
ঢাকার কোথায় কোথায় ডে–কেয়ার আছে, কতক্ষণ শিশুসন্তানকে রাখা যায়, খাবারদাবার কী, খরচপাতি কেমন—এবার এসব জানার পালা। ফেসবুকে ‘ডে–কেয়ার সেন্টার নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম গ্রুপ’ নামের একটি গ্রুপে প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে গেলাম। মগবাজারের বাসা থেকে একদম কাছে হওয়ায় সাতরাস্তার ভূমি ভবনের দিবাযত্ন কেন্দ্রে খোঁজ নিতে গেলাম।
সেখানে পরিবেশ, খাবার, খেলাধুলা, ব্যায়াম, চিকিৎসাসহ একজন শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ব্যবস্থাই রয়েছে। ওখানে ছয় মাস থেকে চার-পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চারাও ছিল। কয়েক দফায় খোঁজখবর নিয়ে সুবোধকে ভর্তি করালাম।
প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার পথে ওকে নামিয়ে দিয়ে আসি। অফিস সময়টা ডে–কেয়ারেই থাকে। শুরুতে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে একটু সময় লেগেছিল। প্রথম কয়েক দিন মনটা একটু ভার থাকত।
তবে সপ্তাহখানেকের বেশি সময় নেয়নি। এর মধ্যে বন্ধু জুটে গেছে; গলায়-গলায় ভাব। ডে–কেয়ারে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। নামিয়ে দেওয়ার পর হাসি হাসি মুখে হাই ফাইভ করে বলে, ‘বাই, বাবা।’ ওর মা অফিস শেষে ডে–কেয়ার থেকে নিয়ে বাসায় ফেরে।
শিশুরা বরাবরই অনুকরণপ্রিয়; অন্যকে দেখে শেখে। দিবাযত্ন কেন্দ্রে বন্ধুদের নিজ হাতে খেতে দেখে নিজেও চেষ্টা করেছে এবং পেরেছে। খেলাধুলার পাশাপাশি গল্পের ছলে আঁকাআঁকি, আদবকেতা সবই শিখেছে।
সরকারি ডে–কেয়ারে শিশুদের জন্য একই রঙের পোশাক পরতে হয়। অভিভাবকেরাই সেটা কিনে দেন। এতে শিশুরা যতটা সম্ভব শ্রেণি বিভাজন থেকে দূরে থাকে; কার পোশাক দামি, কার পোশাক কম দামি, এমন ধারণা তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকে না।
সাতরাস্তার ভূমি ভবন ছাড়া মহাখালী, তেজগাঁও, মতিঝিল, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মালিবাগসহ ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় সরকারি ডে–কেয়ার রয়েছে। বেসরকারি দিবাযত্নের তুলনায় সরকারিতে স্বাভাবিকভাবেই খরচ কম। কোন ডে–কেয়ার কেমন, ফেসবুক গ্রুপগুলোয় রিভিউ পাবেন, সেটা ডে–কেয়ার নির্বাচনে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারে।
ভূমি ভবনে পাঁচ মাসের মতো ছিল সুবোধ। এর মধ্যে মগবাজারের ভাড়া বাসা ছেড়ে নিকেতন বাজারে ভাড়া বাসায় উঠি। ফলে ভূমি ভবন দিবাযত্ন কেন্দ্র ছাড়তে হয়। বাসার কাছে নিকেতনের বেসরকারি এবিসি আর্লি লার্নিং ডে–কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করি। প্রায় দুই বছর ধরে ও ওখানেই থাকছে।
বয়সভেদে এখানে শিশুদের গল্প শোনানো, আঁকাআঁকি ও ক্র্যাফট শেখানো হয়। প্রতি শীতে চড়ুইভাতিও থাকে। বাচ্চারা বাড়ি থেকে গাজর, শিমসহ নানা তরকারি এনে উৎসবের আমেজে রান্নাবান্না করে। শিশুদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস পালন করা হয়।
পশ্চিমা দেশগুলোয় ডে–কেয়ার তাদের জীবনযাপনের অংশে পরিণত হয়েছে। তবে বাংলাদেশে বিষয়টি নিয়ে এখনো কারও কারও মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। পাশাপাশি সামাজিকভাবে এখনো সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে শিশুসন্তানকে ডে–কেয়ারে রাখতে পরিবার তো বটেই, সমাজের সঙ্গেও একধরনের লড়াই করতে হয়। সন্তানের দায়িত্ব মা-বাবা দুজনেরই। কিন্তু আমাদের সোসাইটি সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব মায়ের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। সন্তানকে দেখভালের প্রশ্নে কর্মজীবী নারীর ওপর পরিবার ও সোসাইটির খড়্গটা নেমে আসে; বাধ্য হয়ে অনেক কর্মজীবী নারীকে চাকরি ছাড়তে হয়।
এই পথটা পরিহার করতে হবে। এ জন্য কর্মজীবী দম্পতিরা ডে–কেয়ারকে সমাধান হিসেবে নিতে পারেন। স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরিও করতে পারবেন পাশাপাশি শিশুসন্তানকে নিরাপদে বড় করে তুলতেও পারবেন।
সুবোধের বয়স এখন চার বছর, এর মধ্যে আড়াই বছর ধরে দিবাযত্ন কেন্দ্রে আছে। আগামী জানুয়ারিতে তাকে স্কুলে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। সে হিসেবে ডিসেম্বরে সে দিবাযত্ন কেন্দ্রের জীবনযাত্রার ইতি টানবে। এ সময়ে এসে মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস দিবাযত্ন কেন্দ্র ছিল! ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী না হয়ে ওকে ভর্তি করিয়েছিলাম! দিবাযত্ন কেন্দ্রে সুবোধ অনেক কিছু শিখেছে, মা–বাবা হিসেবে আমরাও শিখেছি।
দেশে আরও দিবাযত্ন কেন্দ্র হোক। কর্মজীবী মা–বাবার সন্তানেরা নিরাপদে বেড়ে উঠুক।
লেখক: সংবাদকর্মী