ভিনসেন্ট চ্যাং ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য। এমআইটি, হার্ভার্ড, ইয়েল, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের মতো একাধিক নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন তাইওয়ানে জন্ম নেওয়া এই শিক্ষাবিদ। প্রথমা থেকে প্রকাশিত ভিনসেন্ট অব বাংলাদেশ বইতে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের শিক্ষা এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেছেন তিনি। পড়ুন নির্বাচিত অংশ।
২০১৯ সালে বাংলাদেশে এসেছিলাম সামান্য ধারণা আর অভিজ্ঞতা নিয়ে; কিন্তু চার বছর পর এ দেশটা আমার জীবনে ফেলেছে গভীর প্রভাব। বাংলাদেশে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আমি নেমে পড়ি এক দারুণ যাত্রায়। আমার দৃষ্টি ছিল মানোন্নয়ন, লক্ষ্য নির্ধারণ এবং শিক্ষায় শ্রেষ্ঠত্বের ধারা তৈরির দিকে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে ব্র্যাক কিংবা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কিছুই জানতাম না, এমনকি বাংলাদেশেও কোনো দিন যাইনি। এমনকি তার আগে বাংলাদেশে যাওয়ার কথা কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলাম? না, ভাবিনি।
চীন থেকে প্রস্তাব পাওয়ার আগে কোনো দিন চীনে যাইনি। ওমান থেকে প্রস্তাব পাওয়ার আগেও একই ব্যাপার ছিল, কোনো দিন সেখানে যাইনি। চীনে যাওয়া আমার কাছে ছিল চাঁদে যাওয়ার মতো, ওমানযাত্রাটা ছিল মঙ্গল অভিযাত্রার মতো; আর বাংলাদেশযাত্রা ছিল আমার কাছে সাক্ষাৎ ‘গভীর সমুদ্র অন্বেষণ’। ফলে বাংলাদেশে যাওয়ার আগে নিজেকে প্রস্তুত করার আদতে তেমন কিছুই ছিল না, শুধু খানিকটা জেনে–বুঝে নেওয়া ছাড়া। তাই বাংলাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে পড়তে বসি। উন্নয়ন অর্থনীতি পড়ার সুবাদে বাংলাদেশ সম্পর্কে সামান্য ধারণা অবশ্য ছিল। যখন ছোট ছিলাম, তখন শুধু জানতাম, দেশটি পাকিস্তানের অংশ। সে সময় দেশটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। তাই নিজেকে মানসিকভাবে এভাবেই প্রস্তুত করছিলাম, যেন গভীর সমুদ্র অন্বেষণে নামছি। কেন গভীর সমুদ্র?
আমার কাছে চীনের প্রকল্পটি ছিল একেবারে স্পষ্ট। ওরা দুনিয়ার সেরা ব্যবসাসংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে চেয়েছিল; আর শুরুটা ছিল একেবারে শূন্য থেকে। মানে আপনি লক্ষ্যটা খুব ভালো করে জানেন। ব্যাপারটা এমন যে আপনি চোখের সামনে চাঁদটা দেখতে পাচ্ছেন। আপনি জানেন, কোথায় যেতে হবে। ওমানের মিশনটা ছিল মঙ্গলে যাওয়ার মতো। যাত্রাটা আরও দূরের, লক্ষ্যটা অস্পষ্ট, বেশ অস্পষ্ট। তবে লক্ষ্যটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন ঠিকই!
বাংলাদেশের বেলায় মিশনটা ছিল জটিল। কারণ আমি জীবনে বাংলাদেশ তো দূরের কথা, দক্ষিণ এশিয়াতেও যাইনি। ফলে ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল গভীর সমুদ্রে নামার মতো। আপনি যখন গভীর সমুদ্রে নামেন এবং যথেষ্ট গভীরে চলে যান, তখন আপনার দৃষ্টিসীমা মাত্র আধা কিংবা এক মিটারে বাঁধা। আপনি তখন জানেন না কী করবেন, তবে এটা ঠিকই জানেন যে এই যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। ফলে আমি জানতাম, একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। তবে চ্যালেঞ্জটা যে কেমন, তা জানতাম না। এটা না জানলেও চ্যালেঞ্জটির মুখোমুখি হতে আমার প্রস্তুতি ঠিকই ছিল।
২০১৮ সালের গ্রীষ্ম। প্রথমবারের মতো দেখা হলো জনাব (ফজলে হাসান) আবেদের সঙ্গে। শুরুতে আমরা মোটেও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কথা বলিনি। তিনি কথা শুরুই করেছিলেন শেকসপিয়ার নিয়ে। তারপর আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও টি ই লরেন্সের কথা। ব্যাপারটা ছিল দুই বন্ধুর খোশগল্পের মতো।
আগেই বলেছি, যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত ব্র্যাক কিংবা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমার জানাশোনা ছিল শূন্য। তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা একাত্ম হলাম কীভাবে? আমি বলব, এটা হয়েছে জনাব আবেদের দর্শনের কারণে। প্রথম দিনেই উপলব্ধি করেছিলাম যে তিনি কিছু একটা করতে চান। সমাজে বৃহত্তর প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা দেখেছিলেন বলেই তিনি একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। প্রথম সাক্ষাতে জনাব আবেদ আমাকে বললেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার ভাবনা কী?’
আমি বললাম, ‘ভালোভাবে চালাতে পারলে এটা আজীবন টিকে যাবে।’
সেই থেকে যাত্রাটা বেশ ভালোভাবেই শুরু হলো। জনাব আবেদের যে দর্শন, সমাজে তার বিশাল প্রভাব আছে। তাঁর এই দর্শনের সঙ্গে আমার ক্যারিয়ারের দর্শন ও লক্ষ্য মিলে গিয়েছিল। তখন মনে হয়েছে, পরিবর্তন আনা এবং বৃহত্তর প্রভাব ফেলার জন্য এটা একটা ভালো সুযোগ। চীনে দায়িত্ব সমাপনকে আমি চাঁদে সফল অবতরণের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তারপর চেয়েছিলাম মঙ্গলে যাওয়ার মতো আরও বড় কিছু করতে। ওমান আমাকে সে সুযোগ দিয়েছিল।
জনাব আবেদের সঙ্গে কথা বলার পর এবং বিশ্বমানের একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পেছনে তাঁর যে দর্শন, সে সম্পর্কে জানার পর মনে হয়েছে, এটা আমার সঙ্গে জুতসই। আরও মনে হয়েছে, দুনিয়ায় এমন লক্ষ্যকেন্দ্রিক প্রকল্প আছে হাতে গোনা। পাশাপাশি জনাব আবেদের খ্যাতি অনন্য। সে সময় তাঁর স্থাপিত বেসরকারি সংস্থাটি পেরিয়ে এসেছে ৪৭ বছর, যার যাত্রা অব্যাহত। মোটকথা আমি আমার জুড়ি খুঁজে পেয়েছিলাম। এ কারণেই ঠিক করি, বাংলাদেশে আমি যাবই যাব।
প্রথম যখন বাংলাদেশে পা রাখলাম, বিশেষত প্রথম সপ্তাহটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। জীবনে কিছু বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো পয়লাবারের মতো। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে থাকা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে এসব অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলাম সে সময়। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কেমন দেখছ?’ খানিকটা রসিকতা করেই বলেছিলাম, ‘ভালোই, ম্যাকডোনাল্ডস নেই, স্টারবাকস নেই, অপেরা নেই, থিয়েটার নেই, ট্রাফিক বাতিও নেই। মানে বাতি ঠিকই আছে, তবে বাস্তবে ওসব কাজে লাগে না।’
এ ছাড়া এখানে দূষণ আছে। বায়ু মারাত্মক দূষিত, ঢাকা ভীষণ কোলাহলমুখর আর আছে মশা।
আমি একবার আমার এক বক্তব্যে নেভিল শুটের (১৮৯৯-১৯৬০) একটা বাণী ধার করেছিলাম। দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন এই ব্রিটিশ লেখক। দুই শতক আগে অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখার পর তিনি বলেছিলেন, ‘একটা ব্যাপার বেশ মজার। আপনি যখন একটা নতুন দেশে যাবেন এবং আশা করবেন সবকিছুই হবে ভিন্ন, ঠিক তখন খেয়াল করবেন, আদতে অনেক কিছুই অভিন্ন।’
দুনিয়ার যেখানে, যে লক্ষ্যেই গেছি—চীন, ওমান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা বাংলাদেশ, সবখানে মানুষে মানুষে মিল পেয়েছি অনেক কিছুতে। মিলটা হলো আমরা সবাই মানুষ। এখানেই আমার আত্মবিশ্বাস এবং আমি জানি, চ্যালেঞ্জ থাকবেই। ঢাকায় প্রথম যে বিষয়টা খেয়াল করেছি, তা হলো কোলাহল। তবে অন্যদিকে এই কোলাহলে একটা শক্তির খোঁজও পেয়েছি। শক্তিটা মানুষের ভেতরের। আমি দেখেছি, এই কোলাহলে মানুষ ছুটছে রুটিরুজির জন্য। চ্যালেঞ্জ যা-ই হোক, তারা হাল ছাড়ার পাত্র নয়, তারা প্রতিনিয়ত উপায় বের করছেই। আর এসব তারা করছে জীবনটাকে আরেকটু উন্নত করার আশায়।
ইংরেজি থেকে অনুদিত