ক্যানসারের ঝুঁকি কমাবে যেসব খাবার

সাইট্রাস ফলে ভিটামিন সি ছাড়াও রয়েছে নানা পুষ্টি উপাদান। মডেল: জেরিন তাসনিম
ছবি: সুমন ইউসুফ

একক কোনো খাবার ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে না। তবে সুষম পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। একদিকে যেমন কিছু কিছু খাবার নিয়মিত পাতে রাখার অভ্যাস করতে হবে, অন্যদিকে কিছু খাবারকে ‘না’ বলতে হবে। 

আসুন জেনে নেওয়া যাক ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে কী ধরনের খাবার দৈনিক খাদ্যতালিকায় রাখা যেতে পারে—

রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল

দৈনিক একধরনের সবজি না খেয়ে বিভিন্ন ধরনের রঙিন শাকসবজি খেতে হবে। কারণ, একটি রঙিন ডায়েট আপনার ক্যানসার লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। বিভিন্ন রঙিন শাকসবজিতে ক্যারোটিন, বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন (সি, ই, ফলিক অ্যাসিড ইত্যাদি), মিনারেল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পলিফেনল ও ফাইটোকেমিক্যাল রয়েছে, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। বোস্টনের হার্ভার্ড টিএইচ স্কুল অব পাবলিক হেলথের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন পাঁচটির বেশি ফল ও শাকসবজি যাঁরা খেয়েছেন (এর চেয়ে কম খাওয়াদের তুলনায়), তাঁদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি ১১ শতাংশ কম ছিল। এর মধ্যে ক্রুসিফেরাস (বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকলি, চায়না ক্যাবেজ, ওল, কেইল ইত্যাদি) সবজি, কমলা, লাল ও হলুদ রঙের সবজি বিশেষভাবে উপকারী। ক্রুসিফেরাস সবজিতে সালফোরেন, আইসোথায়ানেট, ইনডোল এবং উচ্চমাত্রার গ্লুকোসিনোলেটস নামের ফাইটোক্যামিকেল থাকে, যা ফুসফুস, পাকস্থলী, কোলন ও স্তন ক্যানসারের বিকাশ ও অগ্রগতি ঠেকাতে সাহায্য করে। এ ছাড়া এসব রঙিন সবজিতে আছে উচ্চমাত্রার আলফা ও বিটা ক্যারোটিনয়েড, যা স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। আলফা ও বিটা ক্যারোটিন হলো ক্যারোটিনয়েড রঙিন ফল ও সবজিতে পাওয়া একধরনের ফাইটোকেমিক্যাল। আমাদের শরীর আলফা ও বিটা ক্যারোটিনকে ভিটামিন এ-এর সক্রিয় আকারে রূপান্তরিত করে। তাই আমাদের খাদ্যতালিকায় প্রতিদিন ক্যারোটিন-সমৃদ্ধ খাবার রাখা উচিত, যেমন গাজর, মিষ্টি আলু, কুমড়া, অ্যাপ্রিকট, বেলমরিচ ইত্যাদি। যেসব নারী সপ্তাহে তিনটি বা এর বেশি গাজর খেয়েছেন (মাসে একবারের কম গাজর খাওয়াদের তুলনায়), তাঁদের স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি ১৭ শতাংশ কম। ক্যারোটিনয়েড সবজি ক্ষতিকর কোষের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে এবং কোষের বৃদ্ধি দমন করে, যা পরে বিভিন্ন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এ জন্য প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম শাকসবজি ও ফল খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

টকজাতীয় যেসব ফল ক্যানসাররোধী

টক ফলে পর্যাপ্ত ভিটামিন সি রয়েছে, যা কোষ রক্ষাকারী হিসেবে ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে কাজ করে। এ ছাড়া ভিটামিন সি কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও অ্যানিমিয়া রোধ করতে সাহায্য করে। সাইট্রাস ফলে ভিটামিন সি ছাড়াও রয়েছে ভিটামিন এ, আঁশ, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম। টকজাতীয় ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আঁশ আছে কমলালেবুতে। এরপরই আছে জাম্বুরা। কমলা ও আঙুরে মোট ফাইবারের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হলো দ্রবণীয়, যা কোলেস্টেরল কমাতে আর রক্তে শর্করার বৃদ্ধি কমাতে সাহায্য করে। টক ফলের পাল্প ও রসে বিভিন্ন প্রকার ফ্ল্যাভোনয়েড রয়েছে। এ ছাড়া টক ফলের খোসায় লিমোনয়েড ও ট্যানগেরিটিন নামক ফাইটোকেমিক্যাল রয়েছে। এসব উপাদান কেমোপ্রতিরোধী এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা কোলন ক্যানসারসহ একাধিক ক্যানসারের প্রতিরোধক। জুসের থেকে গোটা ফল খেলে ৫ গুণ বেশি ফ্ল্যাভোনয়েড পাওয়া যায়। ফ্ল্যাভোনয়েডে ভালো অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ক্যানসারের কার্সিনোজেন নির্মূল করে প্রদাহ কমায়। 

লাইকোপেন

লালরঙের খাবারকে বলে লাইকোপেন

যেসব খাবার লাল রং ধারণ করে, তাদের বলে লাইকোপেন। লাইকোপেন একটি অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, যা প্রোস্টেট, ফুসফুস, পাকস্থলীসহ নানা ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। গবেষণার তথ্যমতে, টিউমারের বৃদ্ধি কমাতে লাইকোপেনের বিশেষ ক্ষমতা আছে। লাইকোপেন–সমৃদ্ধ খাবারের একটি হচ্ছে টমেটো। তবে টমেটো কাঁচা না খেয়ে রান্না করলে লাইকোপেন বাড়ে। অলিভ অয়েলের মতো তেল দিয়ে রান্না করলে লাইকোপেনের শোষণক্ষমতা বাড়ে।

বেরিজাতীয় খাবার

স্ট্রবেরি টার্ট

স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, চেরি ও জামের মতো বেরিজাতীয় খাবার বিভিন্ন ফাইটোকেমিক্যাল ও পুষ্টি সরবরাহ করে। এগুলো রক্তে অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের কার্যকলাপ বাড়ায়, ডিএনএর ক্ষতি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

গোটা শস্য

লাল চালের ভাত ক্যানসার ঠেকাতে ভুমিকা রাখে

ওটস, বার্লি, লাল চাল, লাল আটা, কুইনোয়া মতো বিভিন্ন গোটা শস্যে পর্যাপ্ত ফাইবার, ফাইটোকেমিক্যাল, প্রিবায়োটিক থাকে। আর এ ধরনের খাবার স্তন ক্যানসার, কোলেস্টেরল ক্যানসারসহ বিভিন্ন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে পারে। তাই খাদ্যাভ্যাস বদলালে, বিশেষ করে সাদা চাল-আটার মতো রিফাইন করা খাবার বাদ দিয়ে লাল চাল বা লাল আটার অভ্যাস করলে সেটা দীর্ঘমেয়াদি আপনাকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে এসব গোটা শস্য ক্যানসারের ঝুঁকি কমাবে।

ডাল, মটরশুঁটি, শিমজাতীয় খাবারে ফাইবার, প্রতিরোধী স্টার্চ ও ফেনোলিক থাকে, যা অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়তা করে, সেই সঙ্গে ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে। 

বাদামজাতীয় খাবার

আখরোট

সব ধরনের বাদামে রয়েছে ক্যানসার প্রতিরোধী পুষ্টি উপাদান। তবে গবেষণা বলছে, আখরোট এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপকারী। কারণ, আখরোটে রয়েছে এলাগিটানিন, মেলাটোনিন আর গামা টেকোফেরল—যা বিভিন্ন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। শরীরে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট লেবেল কমে গেলে অঙ্গ ও টিস্যুর যে ক্ষতি হতে পারে, সেটি ঠেকায় বাদামের নানা উপাদান। 

পানীয়

গ্রিন টিতে শক্তিশালী অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট এপিগ্যালোকটচিন গ্যালেট-৩ আছে, যা ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে

পানীয়র মধ্যে কফিতে রয়েছে ফাইটোকেমিক্যাল, যা এন্ড্রোমেট্রিয়াল এবং লিভার ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। একই সঙ্গে গ্রিন টিতে শক্তিশালী অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট এপিগ্যালোকটচিন গ্যালেট-৩ আছে, যা ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিশেষ করে মূত্রাশয়ের ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে পারে এই চা। তবে অবশ্যই পরিমাণমতো খেতে হবে।

ডালিম ও আপেল

আপেলে থাকা পেকটিন ফাইবার অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে সাহায্য করে, যা কোলন ক্যানসার থেকে রক্ষা করে। মডেল: জেরিন

ডালিমের রসে গ্যালো এলাগিটানিন, ফ্ল্যাভোনয়েড এলাজিক অ্যাসিড, লুটিওলিন, গ্লাইকোসাইডস, কোয়াসেটিন, কেমফেরল আছে। এসব উপাদান কোলন ক্যানসার, স্তন ক্যানসার ও পাকস্থলীর ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। আর আপেলে ভিটামিন সি, ফাইবার ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য আছে। এতে থাকা পেকটিন ফাইবার অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া তৈরি করতে সাহায্য করে, যা কোলন ক্যানসার থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়া আপেলের খোসায় থাকা ফাইটোকেমিক্যাল বিভিন্ন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

তৈলাক্ত মাছ

ইলিশের মালাইকারি

ইলিশ, পাঙাশ, রুই, স্যামন, সার্ডিনের মতো তৈলাক্ত মাছে ভিটামিন বি, পটাশিয়াম, ওমেগা–থ্রির মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি রয়েছে। গবেষণার তথ্য বলছে, যাঁদের খাবারে এ ধরনের তৈলাক্ত মাছ বেশি ছিল, তাঁদের কোলেরেক্টাল ক্যানসারের ঝুঁকি ৫৪ শতাংশ কম ছিল; পাশাপাশি প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকিও কম ছিল।