নড়াইল শহরের শিবশংকর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়াল ঘেঁষে একটু দক্ষিণে এগিয়ে গেলেই বাড়িটা। চারতলা ভবন। খুবই সাদামাটা। তবু বাড়িটির কাছে এলে চোখ আটকে যাবে। ছাদ থেকে বড় বড় গাছ ডালপালা মেলে দিয়েছে বাইরের দিকে। কেমন একটা শান্তি শান্তি ভাব।
বাড়ির তৃতীয় তলায় স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন তনিমা। কলবেল চাপতেই দরজা খুলে দিলেন বড় মেয়ে নুসরাত হক। সাজানো–গোছানো ড্রয়িংরুমে বসতেই হাসিমুখে সামনে এলেন তনিমা আফরিন। সঙ্গে স্বামী নাজমুল হক ও ছোট মেয়ে হৃদিকা হক। এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন তনিমা আফরিন। স্বামীর সঙ্গে কর্মস্থলে কেটেছে অধিকাংশ সময়। সেসব জায়গায় থাকতেও বেলকনিতে বাগান করতেন তনিমা। দুই বছর হলো সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন নাজমুল হক। তারপর থেকে স্থায়ীভাবে নড়াইলের এ বাড়িতেই আছেন। এই বাড়িতেই ছাদবাগান করে সম্প্রতি মিলেছে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার।
যেভাবে শুরু
মা তহমিনা হুসাইন ছিলেন কৃষি কর্মকর্তা। ছোটবেলা থেকেই মাকে দেখেছেন নানা ফল ও ফুলের গাছ লাগিয়ে বাড়ি ভরে ফেলছেন। অফিস থেকে বাসায় ফিরে সেসব পরিচর্যা করতেন। নিয়মিত মায়ের কাছে চাষাবাদের পরামর্শ নিতে আসত লোকজন। এসব দেখে দেখেই বড় হয়েছেন তনিমা। গাছপালা ভরা পরিবেশে বড় হয়েছেন বলেই ছোটবেলা থেকে গাছের প্রতি আকর্ষণ। নড়াইল শহরে বাড়ি করার পর থেকে সেখানে বসবাস শুরু করেন। স্বামীর কর্মস্থল থেকে নড়াইলের এই বাড়িতে আসার সময়ে ৪০টি টবে করে গাছ নিয়ে আসেন তনিমা। শুরু করেন ছাদবাগান। দেশের নামকরা নার্সারিগুলোতে গিয়েছেন অভিজ্ঞতা নিতে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে দেখেছেন ছাদবাগান। সেখান থেকে কখনো ট্রেনে, কখনো বাসে করে অনেক কষ্টে গাছ নিয়ে এসেছেন।
কথায় কথায় জানালেন, শখ থেকেই মূলত বাগান করা। সেখান থেকে নেশা। আর এখন এটাই পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও বাগান থেকে আয় করতে হবে, পুরস্কার পেতে হবে—এসব কখনো ভাবনায় আসেনি। প্রতিদিন ৪-৫ ঘণ্টা ছাদেই কেটে যায়। গাছের পরিচর্যা, পানি দেওয়া, ঘাস পরিষ্কার করা কত কাজ। পোকা লাগল কি না, তা দেখতে হয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কোন গাছের কখন কী খাবার লাগবে, সেসবও খেয়াল রাখতে হয়।
বাগানে গাছের সমারোহ
আলাপ করতে করতেই ছাদে নিয়ে গেলেন তনিমা আফরিন। দরজা ঠেলে ছাদে উঠতেই মুখোমুখি দুটি বেঞ্চ। আয়েশ করে বসার ব্যবস্থা। বিভিন্ন ধরনের গাছ প্রজাতি অনুযায়ী সারি সারি সাজানো। লোহার পাত দিয়ে তাক তৈরি করে, তার ওপর রাখা অধিকাংশ টব। সরাসরি ছাদের ওপরও রাখা আছে অনেক টব। উত্তর ও দক্ষিণ দিক পাকা করে হাউস বানানো হয়েছে। তার ভেতর মাটি দিয়ে লাগানো হয়েছে গাছ। প্রতিটি সারির মাঝে পথ। কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনা নেই। সব গাছেই যাতে রোদ লাগে এমনভবে গাছগুলো সাজানো। প্রতিটি গাছের পাশে দাঁড়ানোর সুবিধা আছে। সবুজের সমারোহে অলতো বাতাসে দোলা খাচ্ছে, সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। প্রায় তিন হাজার বর্গফুটের ছাদজুড়ে শতাধিক প্রজাতির গাছ। চারদিকে সবুজে ঘেরা। ফুল-ফল-সবজি কী নেই। আছে ঔষধি, বনসাই, সৌন্দর্যবর্ধক ও দেশ–বিদেশে দুর্লভ গাছপালা। একই গাছের হরেক প্রজাতি।
গোলাপই আছে ৪৫ রকম
ফুলের প্রতি তনিমার আলাদা টান। দেশের নানা জায়গা থেকে জোগাড় করেছেন হরেক রকম ফুলগাছ। গোলাপই আছে ৪৫ প্রকার। ২০ প্রকার জবা ফুল, ৮ প্রকার কাঠগোলাপ, ৫ প্রকার শাপলা, ১০ প্রকার রেইন লিলি। আছে ২৫ প্রকার অর্কিড। সারি সারি শোভা পাচ্ছে অ্যাডেনিয়াম, রঙ্গন, বেলি, মাধবীলতা, পানচাটিয়া, হাসনাহেনা, নন্দিনী, কালঞ্চ, পদ্ম, কাঁটামুকুট, জারবেরা, রজনীগন্ধা, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, পিটুনিয়া, গজানিয়া, পেন্সি, ক্যালুন্ডেলা, স্কটসহ হরেক প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফুল গাছ।
ফল গাছেও ভরপুর তাঁর ছাদ। মৌসুমি ফলের পাশাপাশি আছে বারোমাসি নানা ফল। একই ফলের টক ও মিষ্টি দুই প্রজাতির গাছই আছে। আছে আপেল, আঙুর, মাল্টা, কমলা, কদবেল, সফেদা, রয়েল, জামরুল, বাতাবিলেবু, কাগজিলেবু, বেদানা, আম, তেঁতুল, ড্রাগন, কলা, লিচু, পিসফল, আমড়া, পেয়ারা, শরিফা, কাউফল, আখ ইত্যাদি।
শজনে, পুঁইশাক, বেগুন, উচ্ছে, কলমিশাক, সবুজশাক, লালশাক, ডাঁটা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, টমেটো, শিম, লাউ, কুমড়া, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, শালগম, মুলা, পেঁয়াজ, মরিচসহ নানা সবজির আবাদ করেছেন ছাদে। নিম, তুলসী ও অ্যালোভেরার মতো ভেষজ গাছও আছে। আছে ঘর ও বেলকনি সাজানোর মানিপ্ল্যান্ট, স্নেকপ্ল্যান্ট, পাতাবাহার, বেবিটিয়ারস, কইলাস ও স্পাইডারপ্ল্যান্ট। চায়না বটগাছ, দেশি বটগাছ, পাকুড় ও জেডপ্ল্যান্টের মতো বনসাইগাছও আছে তাঁর ছাদে।
আছে চারটি ফেসবুক গ্রুপ
ছাদবাগানবিষয়ক চারটি ফেসবুক গ্রুপও পরিচালনা করেন তনিমা। বাগানসংক্রান্ত অনেকগুলো গ্রুপের সঙ্গেও যুক্ত আছেন। এসব গ্রুপের মাধ্যমেও নানা রকম চারা সংগ্রহ করেন, পরিচর্যা শেখেন, নিজের অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। বিভিন্ন গাছের চারা উৎপাদন করে সেগুলো ফেসবুকের মাধ্যমেই বিক্রি করছেন তনিমা। তাঁর কাছ থেকে বিনা মূল্যে চারা নিয়ে অনেকেই গড়ে তুলেছেন ছাদবাগান। সেসব বাগানমালিকদের নিজে গিয়ে পরামর্শ দেন। শেখান পরিচর্যার নিয়ম কানুন। তাঁর অনুপ্রেরণায় এভাবে এলাকার অনেক বাড়িতে এখন গড়ে উঠেছে বাগান।
এত রকম গাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যার ব্যয় সামলান কীভাবে? তনিমা আফরিন বলেন, ‘প্রতি মাসে স্বামীর কাছ থেকে সংসার খরচের জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা পেতাম। সেখান থেকে কিছু বাঁচাতাম। হয়তো কোনো মাসে পাঁচ কেজি মাংস দরকার, দুই কেজি কিনে চালিয়ে নিতাম। প্রয়োজনীয় কাপড় ছাড়া বিলাসিতার জন্য অতিরিক্ত পোশাক কিনিনি। এভাবে শুরুর দিকে সংসার খরচের টাকা বাঁচিয়ে বাগান গড়ে তুলি। গত তিন বছর হলো ছাদে নানা রকম চারা তৈরি করে বিক্রি করছি। এতে খরচ ওঠে সংসারেও কিছুটা আর্থিক সুবিধা মেলে। সবজি ও ফল বাজার থেকে তেমন একটা কেনা লাগে না। বরং প্রতি মৌসুমে ছাদে ফলা নানা রকম ফলমূল প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনকে দিতে পারি।’
বাগান করতে আগ্রহীদের প্রতি তনিমা আফরিনের পরামর্শ, বাগান করতে দরকার ধৈর্য আর সন্তানের মতো ভালোবাসা। আমার দুটি মেয়ে যেমন প্রিয়, গাছগুলোও ঠিক তেমনি প্রিয়। কয়েক দিন গাছের কাছে না গেলে কেমন যেন মলিন হয়ে যায় তাদের চেহারা। পাশে দাঁড়িয়ে একটু পাতা নাড়াচাড়া করলে বা টবের ঘাস পরিষ্কার করলে আবার সতেজ হয়ে ওঠে।