জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়েই আলোচনায় আসে #ReverseBrainDrain। অর্থাৎ মেধা পাচার নয়, বরং ভিনদেশ থেকে পড়ালেখা শেষে আমাদের মেধাবীরা যেন ফিরে এসে দেশের কাজে যুক্ত হন, এই ছিল আবেদন। এমন উদাহরণ কিন্তু বিরল নয়, নতুনও নয়। অনেক তরুণই নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে বাইরে লোভনীয় কাজ নিয়ে থেকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও দেশে ফিরে এসেছেন। পড়ুন তাঁদের কয়েকজনের কথা।
বুয়েটে পড়া শেষে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে পিএইচডি করেছেন তাকিয়ান ফখরুল। এখন বুয়েটেই শিক্ষকতা করছেন। তাঁর দেশে ফেরার অনুপ্রেরণা কী ছিল?
‘আমি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিই আমার মা-বাবার কারণে। আমার বাবা মো. ফখরুল ইসলাম ১৯৮০-এর দশকে বুয়েটের অধ্যাপক ছিলেন। তিনিও বিদেশে থাকার সুযোগ পেয়েও দেশে ফিরেছিলেন। দিন শেষে দেশ আর পরিবার আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে হয়তো ভালো চাকরি করব, ভালো গবেষণা করব, কিন্তু পরিবার ও দেশের আবহাওয়া-সংস্কৃতি মিস করব। পিএইচডি শেষ করে মাইক্রোসফট বা ইন্টেলে অনেকেই যোগ দেয়। আমার সামনেও সুযোগ ছিল। আমি দেশে ফিরে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরির চেষ্টা করছি। বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস কৌশল বিভাগের প্রথম বিভাগীয় প্রধান ড. ওয়াকার আহমেদের কথা শুনেছি। তিনি ১৯৪৯ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরে আসেন। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের কথা আমরা জানি। তাঁদের মতো মানুষ ইচ্ছে করলে বিদেশে কাজ করতে পারতেন। তাঁরা দেশে এসে দেশের জন্য কাজ করেছেন, দেশের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। আমি আবার মা-বাবা আর শিক্ষকদের দেখানো পথই বেছে নিয়েছি।’
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে ভিনদেশের নানা প্রতিষ্ঠান থেকেই কাজের ডাক পেয়েছিলেন আমরিন বশির। বিদেশে চাকরি করবেন, নাকি দেশে ফিরবেন, এই প্রশ্ন মাথায় উঁকি দেওয়ার আগেই বাংলাদেশ বিমানের টিকিট কেটে ফেলেন তিনি। দেশে ফিরে গ্রামে গ্রামে শিক্ষা নিয়ে কাজ শুরু করেন আমরিন।
ফেরার অনুপ্রেরণা কী ছিল? জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘একটা ছেলের সঙ্গে একবার পরিচয় হয়েছিল। দুর্গম চরে থাকে। রাতে কেরোসিনের কুপির আলোয় পড়তে হয় বলে কেরোসিনের টাকা জোগাড় করতে সে দিনের বেলা কাজ করত। আমি ম্যাকগিল আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসেও এই ছেলের আগ্রহ দেখে চমকে যাই। আমাদের দেশের মানুষ প্রচণ্ড প্রত্যয়ী। তাঁদের নিয়ে কাজের অনেক সুযোগ আছে। আমি যেমন এখন শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে কাজ করছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাফল্য “বিজনেস কেস” আকারে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করছি।’
কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও ভূগোলে স্নাতক করেছেন আমরিন। পরে হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব এডুকেশন থেকে মাস্টার্স করেছেন শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক নীতি বিষয়ে। এখন ট্রিনিটি কলেজ ডাবলিনে পিএইচডি করছেন। বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে কীভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটাই তাঁর আগ্রহের বিষয়। বলছিলেন, ‘সম্প্রতি টেডেক্সের একটি সম্মেলনে অংশ নিই। সেখানে দেশের গল্প বলেছি। বাংলাদেশের মতো উদীয়মান একটি দেশে কাজের অনেক সুযোগ। এখানে মানুষের জীবনে অনেক পরিবর্তন আনার সুযোগ আছে। এসবের কারণেই আমার ফেরা।’
শাহরিয়ার আহমেদ শুরুতে পড়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। পরে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পপুলেশন হেলথ সায়েন্সেসে মাস্টার্স করেন। বলছিলেন, ‘চিকিৎসা খাতেই যুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি অনেক মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে চেয়েছি। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করতে চেয়েছি। তাই মেডিকেলের পড়াশোনা শেষ করে গবেষক হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগ দিই। পরে কেমব্রিজে পড়ার সুযোগ পাই।
২০২২ সালে ফেলোশিপ নিয়ে পড়তে যাই। বিদেশের করপোরেট বা আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থায় ক্যারিয়ার গড়ার ডাক পেয়েছিলাম। কিন্তু দেশে ফিরেছি নিজের আগ্রহে। দেশের মানুষের করের টাকায় মেডিকেল পড়াশোনা করেছি, তাঁদের সেবা ও উন্নয়নের জন্যও তো কিছু করার আছে।’ এখন দেশেই একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তিনি।’
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারে পড়েছেন কামরুল হাসান। দেশে ফেরার কথা মাথায় রেখেই বৃত্তি বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
তিনি বলছিলেন, ‘আমি চিভেনিং ও ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তি নিয়ে পড়লে আমার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাসের বড় একটা সুযোগ তৈরি হতো। অন্যদিকে চিভেনিং বৃত্তি নিয়ে পড়া শেষে দেশে ফিরে এসে কাজে যুক্ত হওয়ার শর্ত থাকে। অনেকে তাই ইরাসমাস মুন্ডাসই বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। আমি দেশে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞানে পড়েছি। আমার পড়াশোনার পেছনে জনগণের কষ্টের টাকা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে তো দেশের জন্য কিছু করার সুযোগ পাইনি। সে কারণেই যুক্তরাজ্য থেকে পড়া শেষ করে দেশে ফিরে যোগ দিই একটি উন্নয়ন সংস্থায়। এখন গবেষক হিসেবে কাজ করছি। ভবিষ্যতে হয়তো পিএইচডি করতে যাব বিদেশে। কিন্তু আমার পিএইচডির বিষয়ও হবে বাংলাদেশ–সম্পর্কিত, সেটাই আশা করছি। দেশ থেকে এত কিছু পেয়েছি, কিছু তো প্রতিদান দিতে হবে।’
ঢাকার সানবিমস থেকে এ-লেভেল আর ও-লেভেলে করে কানাডায় চলে যান শাদলী রহমান। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতিতে স্নাতক, পরে মাস্টার্স করেন যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতিসংঘ কিংবা বড় কোনো উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন। সেই তাড়নাতেই দেশে ফিরে যোগ দেন একটি উন্নয়ন সংস্থায়। তিনি বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে এমন দেশ, যেখানে বিশ্বের সব বড় বড় উন্নয়ন সংস্থা কাজ করে। জাতিসংঘের এমন অনেক সংস্থা আছে, যেগুলো কানাডায় কাজ করে না, কিন্তু বাংলাদেশে করে। বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে ইন্টার্নশিপ করতে আসে ব্যবহারিক কাজ শিখতে। সেখানে আমার জন্য তো নিজের ঘরে ফেরার বিষয়টি দারুণ।’
শুরুতে তাঁর ফেরার কথা শুনে নাকি বন্ধুরা অবাক হয়েছিল। সবাই যেখানে কানাডা ছুটতে চাইছে, সেখানে শাদলী কেন ফিরলেন, জানতে চেয়েছিল অনেকে। শাদলী বলেন, ‘বন্ধুদের বলেছি, এটা আমার নিজের দেশ। এখানে যেভাবে আমি কাজ করতে পারব, তা তো অন্য কোথাও পারব না। কানাডা-যুক্তরাজ্যের ক্লাসরুমে যা পড়েছি, তার ব্যবহারিক প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছি এখানে। পছন্দের কাজের সুযোগের ডাকেই আমি বাংলাদেশে ফিরেছি।’