আব্বা আছে না! একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে

প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসাবে কাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে পাঠকের কাছে লেখা চেয়েছিল ‘ছুটির দিনে’। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন অনেক পাঠক। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।

বাবার সঙ্গে সোয়েব আল হাসান

আমার শৈশব ছিল বেশ দীর্ঘ। সেখানে কোনো পড়ালেখা ছিল না। টেনশন ছিল না। জীবন নিয়ে ছিল না কোনো ভাবনা। নেপথ্য কারণ, আমার আব্বা।

সাত বছর বয়সে আব্বা আমাকে প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে গেলেন ভর্তি করতে। প্রধান শিক্ষক আমাকে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করেন। আমি তোতা পাখির মতো মুখস্থ আওড়াই। শিক্ষক চিন্তিত। এই বয়সের বাচ্চারা ক্লাস টুতে পড়ে। আমাকে ওয়ানে ভর্তি করলে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারব তো! আব্বা কিছু বলেন না, শুধু মুচকি হাসেন। শেষে প্রধান শিক্ষক আমাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে নেন।

পরদিন আব্বা আমাকে নিয়ে আবার স্কুলে উপস্থিত হলেন। হেডস্যারকে বললেন, ‘ওকে ক্লাস টুতে ভর্তি করে দেন।’

হেডস্যারের চোখ ছানাবড়া, ‘ক্লাস টুতে পড়বে কী! ও তো অক্ষরই চেনে না!’

আব্বা বললেন, ‘মাস্টার সাহেব, আপনার এখানে কোনো বড় ক্লাসের বই থাকলে ওকে পড়তে দিন।’

মাস্টারমশাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ডিগ্রি ক্লাসের বাংলা বই আমার সামনে রাখলেন। হড়বড় করে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরী পড়তে লাগলাম। হেডস্যার আশ্বস্ত হলেন।

আব্বা বললেন, ‘ওকে ভর্তি করে নিন। বাকি সব ব্যবস্থা আমি নেব।’

আব্বা ব্যবস্থা নিয়েছেন।

একবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের হিমুর মতো ঢাকা শহরে ভবঘুরের মতো জীবন কাটাচ্ছি। এক বেলা খাই তো আরেক বেলা খাই না—এমন অবস্থা। ভাইবোনেরাও আমার ওপর ত্যক্তবিরক্ত। কেউ টাকাপয়সা দেয়, কেউ দেয় না। অভিমান করে একদিন ফোন অফ করে রাখলাম। পরদিন ফোন খোলামাত্র আব্বার ফোন। আমি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাউমাউ কান্নার আওয়াজ

ভার্সিটির তৃতীয় বা চতুর্থ সেমিস্টারে পড়ি। কী একটা ব্যাপার নিয়ে রাগারাগি হওয়ার কারণে ভাইয়া আমাকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল। আমি পড়লাম মহা সমুদ্রে। শুধু টিউশনি করে ঢাকায় থাকা খাওয়া পড়াশোনার খরচ জোগানো আমার জন্য পাহাড় ডিঙানোর শামিল। ভার্সিটি, বন্ধুদের আড্ডা, প্রকাশ্য দিবালোক—এসব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলাম। কেউ কোনো কিছু টের পেল না। হঠাৎ একদিন আব্বার ফোন, ‘কী হইছে বাজান?’

বললাম, ‘কিছু হয় নাই, আব্বা।’

আব্বা বললেন, ‘কিছু হবেও না ইনশা আল্লাহ। চিন্তা করিস না। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

সত্যি সত্যি আব্বা ব্যবস্থা নিলেন। ধানি জমি বিক্রি করে আমার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিলেন।

৩.

আমি খুব স্বাধীনচেতা মানুষ। যা ভালো লাগে করি, যা ভালো লাগে না করি না। বর্তমানে যে চাকরিটা করছি, এটা ৮ নম্বর। নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে একটা আইডিয়া পেয়ে গেছেন। তো, এ রকমই একবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের হিমুর মতো ঢাকা শহরে ভবঘুরের মতো জীবন কাটাচ্ছি। এক বেলা খাই তো আরেক বেলা খাই না—এমন অবস্থা। ভাইবোনেরাও আমার ওপর ত্যক্তবিরক্ত। কেউ টাকাপয়সা দেয়, কেউ দেয় না। অভিমান করে একদিন ফোন অফ করে রাখলাম। পরদিন ফোন খোলামাত্র আব্বার ফোন। আমি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হাউমাউ কান্নার আওয়াজ। আমার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না আব্বা। সারা জীবন আব্বার দরাজ কণ্ঠ শুনেছি, শাসন দেখেছি; কিন্তু এমনটি তো কখনো দেখিনি। বললাম, ‘আব্বা, কিছু হয়নি। আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন।’

আব্বা বললেন, ‘চিন্তা করিস না, আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

আব্বা কী ব্যবস্থা নিলেন জানি না। এক সপ্তাহের মধ্যে আমার ভালো একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে গেল।

এ রকম হাজারো ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমি জানিও না, বুঝিও না। শুধু জানি, আব্বা আছে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই অদৃশ্য ব্যবস্থা সবাই করতে পারে না। কেউ কেউ পারে।

ভালোবাসি, আব্বা।