কোনো বিষয়ে কারও সঙ্গে এক মত হতে পারছেন না, অথবা যাঁকে কাজ দিয়েছিলেন, তিনি কাজটি ঠিকভাবে করেনি, কিংবা যেমনটি হবে ভেবেছিলেন, তার উল্টোটি ঘটেছে—যেকোনো পরিস্থিতিতে মনের বিরুদ্ধে কিছু গেলেই অনেকে রেগে যান। না চাইতেও অন্যের ওপর রাগ ঝাড়েন। হয়তো কিছুক্ষণ পরই অনুতপ্ত ও লজ্জিত বোধ করেন। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।
এভাবে রাগের বশবর্তী হয়ে নানান সম্পর্কে যেসব তিক্ততা সৃষ্টি করছেন, সেগুলো ব্যক্তিগত জীবনে কিছুটা সামাল দেওয়া গেলেও কর্মজীবনে বয়ে আনতে পারে নানান ঝামেলা। সহকর্মীদের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠার পাশাপাশি হ্রাস পেতে পারে আপনার কর্মস্পৃহা। তাই কর্মক্ষেত্রে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে না চাইলে বশে আনতে হবে অনিয়ন্ত্রিত রাগ।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, শুধু বোকাদের মনেই রাগ থাকে। যদি তা-ই হয়, তাহলে বলা যায়, পৃথিবীতে বোকা লোকের অভাব নেই। কিন্তু সব সময় বিষয়টি এমন নয়। খুব জ্ঞানী ব্যক্তিও হতে পারেন রাগের বশ। তীব্র হতাশা ও কষ্টের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে রাগ। এটি আর দশটি অনুভূতির মতোই খুব স্বাভাবিক একটি অনুভূতি।
যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা বলছে, যেকোনো ন্যায়সংগত পরিস্থিতিতে ভয়ের চেয়ে রাগ অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর একটি অনুভূতি। রাগ হলে শরীরে কিছুক্ষণের জন্য স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ সৃষ্টির আশঙ্কা কমে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুবিজ্ঞানী ও লেখক আর ডগলাস ফ্লিডস তাঁর ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘ওয়াই উই স্ন্যাপ: আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য রেইজ সার্কিট ইন ইয়োর ব্রেইন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রচণ্ড চাপ ও উদ্বেগ অনুভব করলে আমাদের মস্তিষ্কে রাগ অনুভূত হয়। আরও সহজ করে বলতে হলে, আপনি যদি দিনের পর দিন মানসিক চাপ ও ভয়ের মধ্যে থাকেন, তাহলে আপনার সহ্যের ক্ষমতা কমে যাবে। খুব সামান্য উসকানিতেও আপনি রেগে যাবেন। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে না চাইলে চারটি উপায়ে নিজের রাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারবেন।
১. স্বীকার করুন যে রাগ করে ভুল করেছেন
কারও ওপর রাগ ঝেড়ে ফেলেছেন। মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর এখন অনুশোচনা হচ্ছে। এই অনুভূতি হয়তো অনেকের কাছেই পরিচিত ঠেকবে। অনুশোচনা হলেও খুব কম সময়ই ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। অনুতাপ দমিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে তা একভাবে রেগে যাওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তোলে। তবে যাঁর ওপর রাগ ঝেড়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে ক্ষমা না চেয়ে আগে নিজের ভুল বুঝতে চেষ্টা করুন। তারপর ক্ষমা চেয়ে নিন। এতে অনুশোচনা কমে গেলেও ভবিষ্যতে রাগ হলেও কারও ওপর অযথা রাগ ঝাড়ার আগে ক্ষমা চাওয়ার কথা মাথায় আসবে, তখন নিজেই নিজেকে আটকাতে পারবেন।
২. মাত্রাতিরিক্ত রাগ প্রকাশ থেকে বিরত থাকুন
অনেকেই এমন রেগে যান, যে মনে হয় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। রাগের কারণে কেউ জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করেন, তো কেউ হাতের কাছে যা পান, তা-ই ভাঙচুর করেন। রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেউ কেউ আবার পাঞ্চিং ব্যাগে একের পর এক ঘুষি মেরে রাগ কমানোর চেষ্টা করেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা, ‘ধ্বংসাত্মক আচরণে রাগ কমার চেয়ে উল্টো বেড়ে যায়।’
আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী ব্র্যাড জে বুশম্যান পাঞ্চিং ব্যাগে ঘুষি মেরে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন, এমন কয়েকজনের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, রাগ কমানোর জন্য এমন ঘোষাঘুষি করার চেয়ে কিছু না করাই বেশি কার্যকর। তাই নিজের মনের অবস্থা না বুঝে খালি রাগ প্রকাশ করে রাগ কমানোর চেষ্টা করলে কোনো দিনও নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
৩. নিজের মানসিক চাহিদা বুঝতে চেষ্টা করুন
ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা বলছে, রাগ হলে রাগের কারণ বুঝতে নিজেই নিজেকে এসব প্রশ্ন করতে পারেন:
• কোন জিনিসটি আমাকে রাগাচ্ছে?
• আমার রাগের পেছনে মূল অনুভূতিটা কী, ভয় না শক্তিহীনতা?
• স্বাভাবিক থাকার জন্য এখন আমার ঠিক কি করা প্রয়োজন?
• কোন দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল আমাকে ভালো বোধ করাবে?
• সে ফলাফল অর্জনের জন্য আমি কী কী পদক্ষেপ নিতে পারি?
• পদক্ষেপগুলো নেওয়ার জন্য আমি কী কী ঝুঁকি নেব এবং তাতে আমার কী লাভ হবে?
অনেকের রাগের মূলে থাকে ভয়। শক্তিহীন হওয়ার ভয় কিংবা প্রিয় কিছু হারানোর ভয় থেকে তীব্র রাগ আসতে পারে। আসল কারণ বুঝলে রাগ অনেকটাই নিজের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৪. আবেগপ্রবণ না হয়ে নিজের অনুভূতি নিয়ে কথা বলুন
কিছুদিন আগে ভারতের একটি অফিসের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, ১২ মাস ধরে কোনো প্রণোদনা না দেওয়ায় এক নারী কর্মী তাঁর উচ্চতর কর্মকর্তাদের ওপর চেঁচাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে আপনার রাগ যদি অন্যের কারণে ত্বরান্বিত হয়, তাহলে রেগে না গিয়ে সেই মানুষটির সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় নিজের অনুভূতির কথা বলতে চেষ্টা করুন।