৩ নম্বরের জন্য স্বপ্নভঙ্গ, অতঃপর আরেক স্বপ্নপূরণ

সানজিদা নুসরাত
ছবি: সংগৃহীত

একদম ছোট্টবেলা থেকেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার স্বপ্ন। সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছেন সানজিদা নুসরাত। ছোটবেলায় পড়েছেন টাঙ্গাইলের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। বাবার চাকরির সুবাদে কলেজে উঠে ঠিকানাবদল। ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেন সানজিদা।

পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। বিতর্ক, গণিত অলিম্পিয়াড, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা—সবকিছুর সঙ্গেই ছিল যুক্ততা। কলেজে উঠে পদার্থবিজ্ঞানটা একটু বেশিই ভালো লেগে যায়। ফিজিকস অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বে ভালো করার ফলে ক্যাম্পেও ডাক পান।
সানজিদা বলেন, ‘অলিম্পিয়াড কমিউনিটির বেশির ভাগেরই উচ্চতর শিক্ষার জন্য সাধারণত বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন থাকে। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েট। তাই কলেজে পড়ার সময়ই পদার্থবিজ্ঞান, উচ্চতর গণিত, রসায়নের ওপর একটু বেশি জোর দিয়েছি।’
কিন্তু ভাগ্যে লেখা ছিল অন্য কিছু। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে বুয়েটের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, পরীক্ষা দিতে হলে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে মোট ২৭০ নম্বর থাকতে হবে। সানজিদার ছিল ২৬৭। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে এত প্রস্তুতি, সেখানে পরীক্ষাই দিতে পারবেন না, সানজিদার জন্য এটা বড় একটা ধাক্কা।


পরে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিতু হন সানজিদা। বাবা এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই অ্যালামনাই, সেই সূত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের থেকে সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ ছিল।  

২০ জনের ১ জন
ক্লাস টেস্ট, সেমিস্টার ফাইনালে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন সানজিদা। তারই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) আবেদন করেন। সানজিদার কাছ থেকে জানা গেল, ক্যালটেকে আবেদন করেছিলেন ২০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। সুযোগ পাবেন মাত্র ২১৩ জন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য সমীকরণ আরও কঠিন। ২০ জনেরও কমসংখ্যক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী নেবে কর্তৃপক্ষ। তাই ক্যালটেকে আবেদন করার পরও সানজিদা একরকম প্রত্যাখ্যানপত্রই প্রত্যাশা করছিলেন। কিন্তু ক্যালটেক থেকে ই–মেইল যখন এল, দেখা গেল শুরুতেই লেখা, ‘ডিয়ার সানজিদা নুসরাত, কংগ্রাচুলেশন…’

সানজিদা নুসরাত


অনুমান করি, পুরো ই–মেইলটা একাধিকবার পড়েছেন সানজিদা। স্বপ্নভঙ্গের পর নতুন করে স্বপ্নপূরণের পথ খুঁজে পেতে তাঁকে কম কষ্ট করতে হয়নি। এইচএসসি পাসের পর আবার এ-লেভেলের প্রস্তুতি নিয়েছেন, উচ্চশিক্ষার পথটা সুগম হবে বলে। পাশাপাশি আরও অনেক চ্যালেঞ্জই তাঁকে সামাল দিতে হয়েছে।
মাইগ্রেনের সমস্যা সানজিদাকে প্রায়ই ভোগায়। কাজের চাপ বেশি হলেই অসুস্থতা জেঁকে বসে। এত সবের মধ্যেও একটানা পরিশ্রম করে যেতে পারেন এই শিক্ষার্থী। সানজিদা বলেন, ‘আমার হলমেট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বান্ধবী আমাকে বলত সুপারওম্যান। কারণ, আমি না ঘুমিয়ে একটানা কাজ করতাম। অনেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমাকে যেভাবে টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকতে দেখত, ঘুম থেকে উঠে ঠিক একইভাবে দেখে অবাক হতো। বাসায় যখন থাকতাম, মা বলত, “রাত ১২টা বাজে। আমাদের কাছে রাত হলে কী হবে, ওর তো মাত্র সকাল শুরু হলো, হা হা!” আর বাবা সব সময় মজা করে বলত, “বিজ্ঞানী হওয়ার চেষ্টা করতেছে।” এই দিনগুলোর কথা আমার সারা জীবন মনে পড়বে।’
সবকিছু ঠিক থাকলে, সেপ্টেম্বরে শুরু হবে ক্লাস। জৈবিক প্রকৌশল বিষয়ে পাঠ নেবেন সানজিদা। তবে তড়িৎ প্রকৌশল ও জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের প্রতিও তাঁর আগ্রহ আছে। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান সব বিষয়েই। সানজিদা যোগ করেন, ‘ক্যালটেকের যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করে, যা আর কোথাও নেই, সেটি হলো, ক্যালটেকের ৭৯ জন নোবেলজয়ীর বেশির ভাগ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ২০১৮ সালে রসায়নে নোবেলজয়ী ক্যালটেকের জীববিজ্ঞান ও জীবপ্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ফ্রান্সেস আর্নল্ডের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে আছে। নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবও ক্যালটেকে, নাসাতেও কাজ করার ইচ্ছা আছে।’