বাংলা মাধ্যম, না ইংরেজি? বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা সুবিধা পান? অসুবিধাই বা কী?

স্কুল পর্যায়ে কেউ বাংলা মাধ্যমে পড়েন, কেউ ইংরেজি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সবাই অবশ্য এক ক্লাসে, একই পাঠ্যক্রমের আওতায় চলে আসে। তখন পড়ালেখায় কারা সুবিধা পায় বেশি? বাংলা মাধ্যম নাকি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা? অসুবিধাই–বা কী কী? জানিয়েছেন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

স্কুল পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সবাইকে একই পাঠ্যক্রমের আওতায় পড়তে হয়
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ক্লাসের পড়াশোনা সবার জন্যই সমান

ফারহান তানভীর, আইবিএ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আমি ঢাকা রেসিডেনশিয়াল মডেল কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। আমি ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থী ছিলাম। ইংরেজি ভার্সন মানে বাংলাদেশের সরকারের শিক্ষা পাঠ্যক্রমের ইংরেজি রূপের বইপত্র পড়েছি আমরা। স্কুল-কলেজে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই ক্লাস করেছি। পরীক্ষার খাতায় অবশ্য ইংরেজি ভাষায় লিখেছি। তবে ইংরেজি ভার্সনে পড়ার কারণে স্কুল–কলেজে কিছু সমস্যায়ও পড়েছি। যেমন বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ত করতে আমাদের ইংরেজি ভার্সনের বইয়ের পাশাপাশি বাংলা মাধ্যমের বইও পড়তে হতো।

পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে ভর্তি হই। এখানে কোন মাধ্যমের শিক্ষার্থী এর থেকে বড় হচ্ছে ইংরেজির পারদর্শিতা। বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছে এমন অনেকেই আছে যারা ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের থেকেও এ ব্যাপারে বেশি পারদর্শী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সহযোগিতাপূর্ণ বলে আমি মনে করেছি। আমাদের পড়াশোনার বিষয়গুলো সহজভাবে নিজের মতো উপস্থাপন করাতে চেষ্টা করেন তাঁরা। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে স্কুল–কলেজ পর্যায়ে ইংরেজিকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো উচিত। পাশাপাশি টপিকগুলোর নাম বাংলা আর ইংরেজি দুটিতেই রাখলে ভবিষ্যতে সবার জন্য আরও ফলপ্রসূ হবে।

স্কুলের অনেক কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজে আসছে

ফাবিহা লামিসা, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস

আমি স্কলাস্টিকা থেকে ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল দিয়েছি। এরপর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে ভর্তি হই। আমার পুরো ক্লাসেই ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া শিক্ষার্থী খুব কম। প্রথম দিকে কীভাবে মানিয়ে নেব, এই চ্যালেঞ্জ ছিল। এটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলা মিডিয়ামে পড়ে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা আমার ক্লাসে বেশি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার বা অন্যান্য বিষয়ে ইংরেজি ভাষার চল আছে, তাই কোনো সমস্যা হয়নি। বন্ধু বা ক্লাসমেটদের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নেব, তা নিয়ে বরং চ্যালেঞ্জ ছিল। ক্লাস পরীক্ষা ইংরেজিতে দিতে হয় বলে তেমন কোনো সমস্যায় পড়িনি। সাধারণ পড়াশোনার বিষয়গুলো ভালোভাবেই বুঝেছিলাম। বিভিন্ন টেকনিক্যাল শব্দ বুঝতে বিপদে পড়ে যাই। ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক শব্দ সহজ হলেও সংজ্ঞা অনেক কঠিন, বুঝে মাথায় ধরে রাখা কঠিন কাজ। আমার বন্ধুদের অনেকে ইংরেজিতে যোগাযোগ নিয়ে সমস্যায় পড়ত। তাদের আমি সহায়তা করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোর্সে আমাদের প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হয়। এসব দলীয় কাজে আমার ইংরেজির অভিজ্ঞতা আর বন্ধুদের বাংলাদেশের বাজার, মানুষের ভাবনার অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করে দারুণ সব প্রেজেন্টেশন তৈরি করি আমরা। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সুবিধা তো পাই। ইংরেজিতে যোগাযোগ, ই–মেইল লেখা কিংবা ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন রিপোর্ট ভালোভাবে লেখার কৌশল দ্রুত শিখতে পেরেছি। ‘ও’ লেভেলে পড়ার সময় আমাদের স্কুলেই ক্লাস প্রেজেন্টেশনসহ ডিবেট-কুইজ চালু ছিল। সেসবে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা বেশ কাজে লাগছে। আমার বাংলা মিডিয়ামের অনেক বন্ধুর প্রেজেন্টেশন বা ইংরেজিতে কথা বলায় জড়তা আছে, এটা খুবই স্বাভাবিক। বন্ধুদের এসব ক্ষেত্রে সহায়তা করতে আমি চেষ্টা করি।

বাংলা মিডিয়ামে পড়ে ইংরেজি ভয় কাটতে সময় লাগে

আনিকা বিনতে কামাল, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

প্রাথমিক পর্যায়ে আমি ইংরেজি মিডিয়ামে পড়েছি। পরে স্কুল-কলেজে বাংলা মিডিয়ামে পড়ার সুযোগ পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে পড়ার সুযোগ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইবার সময় ইংরেজিতে কথা বলতে হয়েছিল। তখন কিছুটা ভয়ও পেয়েছিলাম। ইংরেজি ভালো লিখতে পারলেও বলায় আমাদের জড়তা থাকে। সে জড়তা নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। আমাদের ক্লাসের লেকচার ইংরেজিতে দেওয়া হয়, সমস্যা হলে স্যাররা সব সময়ই সহায়তা করেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ফ্যাকাল্টি বিদেশি, শুরুর দিকে তাঁদের ক্লাসগুলোতে কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলাম। আস্তে আস্তে নিজেরা সেসব বিষয়ে অভ্যস্ত হয়েছি। আমাদের অনেক বন্ধু পরীক্ষা দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ত, বাংলা মিডিয়াম থেকে পড়াশোনা করে ইংরেজিতে পরীক্ষা দেওয়া প্রথম দিকে অনেক ভয়ের ছিল। এসব সমস্যায় আমরা নিজেরাই শিক্ষকদের পরামর্শ নিই। বন্ধুরাও সহায়তা করে। আমাদের অনেক দলীয় কর্মকাণ্ড থাকে, দলীয় উপস্থাপনাসহ নানা শ্রেণি কার্যক্রম থাকে। এসবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা জড়তা কাটিয়ে উঠছি। আমার যারা বাংলা মিডিয়াম থেকে ইংরেজি বিষয়ে পড়তে এসেছি, তাদের জন্য এগুলো চ্যালেঞ্জিংই বলা যায়। ফ্লুয়েন্সি নিয়ে ইংরেজি বলার জন্য চর্চা করতে হয়। প্রথম দিকে বুঝতেও অনেক সময় লাগত বা কিছু ওয়ার্ড সাবজেক্টে নতুন লাগত, আস্তে আস্তে শিখছি সব।