কলকাতায় জন্ম নেওয়া তরুণটি বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। গুগল স্ট্রিট ভিউ ঘেঁটে বের করেছিলেন বরিশালে তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটা। এই ছেলে সিনেমা বানাতেন, কবিতা লিখতেন। স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশের প্রথম আলোয় ছাপা হবে তাঁর কবিতা।
কিন্তু এসব স্বপ্ন অসমাপ্ত রেখে মাত্র ২৬ বছর বয়সে অকালেই তাঁকে চলে যেতে হলো।
কলকাতার যুবক ঋতম ব্যানার্জির গল্পটা তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হতে পারত। তবে শেষ যে হলো না, এর পেছনে রয়েছেন তাঁর মা অনুশীল ব্যানার্জি আর বাবা সুরঞ্জন ব্যানার্জি। ছেলে বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিল। তাই গেল ৩০ মে এ দেশে এসেছিলেন এই দম্পতি। ছিলেন ৯ জুন অব্দি। ছেলে নিয়মিত প্রথম আলো পড়ত, এ পত্রিকায় কবিতা ছাপতে চাইত। তাই দেশের শীর্ষ দৈনিকটি দেখার আকাঙ্ক্ষাও তাঁদের ছিল। সেই সূত্রে বেশ আকস্মিকভাবেই এ দম্পতির সঙ্গে আমাদের আলাপ।
‘আমার ছেলেটা বাংলাদেশ নিয়ে এত গল্প করত, এই দেশটা ঘুরতে ঘুরতে সেই স্মৃতিই বারবার মনে পড়েছে,’ কথায় কথায় বলছিলেন ঋতমের মা অনুশীল।
কেন বাংলাদেশে আসতে চাইতেন ঋতম
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটু পেছনে যেতে হবে।
অবিভক্ত ভারতবর্ষের ডাক বিভাগে চাকরি করতেন জ্ঞানরঞ্জন ব্যানার্জি। বরিশাল শহরের কালীবাড়ি সড়কের তিন মাথায় ছিল তাঁদের কাঠের একতলা বাড়ি। এখানেই ১৯৩১ সালে জ্ঞানরঞ্জনের ছেলে নিরঞ্জন ব্যানার্জির জন্ম। এই নিরঞ্জনই ঋতমের দাদা। ১৯৪৫ সালে এই বাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে পাকাপাকিভাবে ‘ওপার’-এর মেদিনীপুরে স্থায়ী হন জ্ঞানরঞ্জন ব্যানার্জি।
শিক্ষাদীক্ষা শেষে ভারতের কৃষি বিভাগে চাকরি নিলেন নিরঞ্জন। বাবা জ্ঞানরঞ্জন ব্যানার্জির মৃত্যুর পর মেদিনীপুর থেকে তিনি ঠাঁই গাড়লেন কলকাতায়। তাঁর জীবনসঙ্গী নীলিমা ব্যানার্জির পূর্বসূরিদের ভিটাও ছিল ফরিদপুরে। এই নিরঞ্জন-নীলিমার ছেলেই সুরঞ্জন ব্যানার্জি। দাঁতের ডাক্তার হিসেবে কলকাতায় তাঁর নামডাকও আছে। তৃতীয় প্রজন্মে এসে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের সুতোটা একেবারেই ছিঁড়ে গেছে।
‘আসলেই কি ছিঁড়েছে?’ ঋতমের বাবা সুরঞ্জন আপন মনে প্রশ্নটি কি নিজেকেই করলেন, নাকি পাশে বসে থাকা তাঁর স্ত্রী অনুশীলের উদ্দেশে করলেন, ঠিক বোঝা গেল না। ৭ জুন বিকেলে প্রথম আলোরদপ্তরে বসে ছেলের গল্প করছিলেন সুরঞ্জন-অনুশীল। ৫৮ বছর বয়সী সুরঞ্জন নিজেই খানিক আগে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘শিকড় কখনো ছিন্ন হয় না, বুঝেছেন। আমার ছেলে বলত, “আবেগ বংশপরম্পরায় প্রবাহিত হয়।” দেখুন, বাংলাদেশ নিয়ে আমার আবেগ থাকলেও ছেলের মতো অতটা ছিল না। এ দেশ নিয়ে আমার বাবা নিরঞ্জন ব্যানার্জি ও ছেলে ঋতম ব্যানার্জির আবেগ ছিল বেশি। তাঁরা এখানে আসতে চাইতেন। ২০২০ সালে আমরা সবাই মিলে একবার আসতেও চেয়েছিলাম। কিন্তু বাদ সাধল করোনা। মহামারির কারণে আসা হলো না। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৯০ বছর বয়সে মারা গেলেন বাবা। তারপর মারা গেল ছেলে। কিন্তু আমরা তো সেই এলাম, আবেগের টানে, শিকড়ের টানে।’
ঋতমের গল্প
১৯৯৪ সালে ‘ইয়ে’ করে বিয়ে করেন ‘বাঙাল’ ছেলে সুরঞ্জন ও লক্ষ্ণৌর মেয়ে অনুশীল। আর কলকাতার এক হাসপাতালে এই যুগলের একমাত্র সন্তান ঋতমের জন্ম হয় ১৯৯৬-এর ২৫ সেপ্টেম্বর।
‘ছোটবেলা থেকেই ঋতম ছিল খুব আবেগপ্রবণ আর স্পর্শকাতর। নিজেই বলত, “আমি একটা ইমোশোনাল সেনসেটিভ ফুল,”’ উদাস চোখে বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব অনুশীল। কলকাতার সাউথ পয়েন্ট হাইস্কুলের তিনি ভূগোলের শিক্ষক।
মা–বাবার ভাষ্যে আস্তে আস্তে আমাদের সামনে আকার পেতে থাকেন ঋতম। ছেলেবেলা থেকেই ঋতম ছিলেন খানিকটা আলাদা। ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করলেও তাঁর লেখালেখি সব বাংলাতেই ছিল। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার ছিলেন প্রিয় লেখক। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী প্রিয় কবি। আর বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদের গদ্য এবং নির্মলেন্দু গুণের কবিতার তিনি ছিলেন মহাসমঝদার।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় সেলফি নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁর হাতেখড়ি। একে একে নির্মাণ করেন ব্রোকেন গান, মহাসপ্তমী, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭, লাইফ অব আ ট্রাভেলার, রাইগর মরটিস, ব্যানডসহ ১০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ব্যানড নামে যে ছবিটি বানিয়েছিলেন, সেটি ২৫তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আঞ্চলিক ভাষার শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি হিসেবে মনোনীত হয়েছিল। আর এ ছবির জন্য কেবল স্বীকৃতি নয়, হুমকিও পেয়েছিলেন ঋতম।
ধর্মীয় উগ্রপন্থা আর উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে কলকাতায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে—এককথায় এটিই ব্যানড সিনেমার গল্প। পশ্চিমবঙ্গের উগ্রপন্থীরা তাই তাঁকে ছেড়ে কথা বলেনি। যে কেউ চাইলে ইউটিউবে এখনো ছবিটি দেখতে পারেন। এ ছবি বানানোর সময় ঋতম ছিলেন কলকাতার কেপিসি মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাবিদ্যার স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্র। ২০২০ সালে ডাক্তারি পাস করেন।
‘এরপর দুনিয়াজুড়ে শুরু হলো করোনা। সব ভুলে কোভিডে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াল ঋতম। দিনভর হাসপাতালে থাকত আর মাঝেমধ্যে ডায়েরিতে কবিতা লিখত,’ ছেলের তখনকার কর্মকাণ্ড নিয়ে বলছিলেন মা অনুশীল।
দাদা-নাতির বাংলাদেশ
করোনার কালো প্রহরে তত দিনে গত হয়েছেন ঋতমের দাদা নিরঞ্জন ব্যানার্জি। কবিতায় ঋতম লিখলেন, ‘কাল স্বপ্নে তোমায় বারবার নিরঞ্জন…দুটো আঙুল খেলা করছিল বহুদিন/ ঘেঁষতে দেয়নি বাকি হাতটাকে/ যদি ভুল করে দেশলাই জ্বালিয়ে রাখে! ...তার চেয়ে রেললাইন ধরে তোমার বাড়ি/ এক জন্মের পথ;/ তৈরি রেখো প্রথম দেখার স্পন্দন—/ চলো, আবার শুরু করি নতুন করে।’
মুঠোফোন থেকে বের করে ‘অতঃপর’ নামের কবিতাটি আমাদের দেখাচ্ছিলেন সুরঞ্জন ব্যানার্জি। এই ফাঁকে অনুশীল বললেন, ‘আমরা ওর লেখা ছাপানোর কথা বললে ও বলত, “মা, তোমরা সবকিছু বেচতে চাও কেন!”’
তাহলে যে প্রথম আলোয় লেখা ছাপানোর কথা বললেন…
‘ও আসলে বাংলাদেশের কোনো দৈনিকে লেখা ছাপাতে চেয়েছিল, যেহেতু সে প্রথম আলো পড়ত, তাই এ পত্রিকার কথা বলেছিল। বাংলাদেশ নিয়ে ওর আবেগের শেষ ছিল না।’
কলকাতার ঋতমের মনে বাংলাদেশ নিয়ে আবেগটা সঞ্চার করেছিলেন আসলে তাঁর দাদা। নিরঞ্জন ব্যানার্জি তাঁকে বরিশালের সেই কাঠের বাড়িটার কথা বলতেন, নদী-খাল–বিল আর মানুষজনের গল্প করতেন। এখানকার লোকেরা গানবাজনায় ভীষণ পটু, বলতেন। বলতেন, তাঁদের বাড়িতে বিশেষভাবে মসুরের ডাল রান্নার কথা। সেই পদ খাওয়ার জন্য কত মানুষের যে আনাগোনা ছিল তাঁদের গৃহে!
এসব শুনে শুনে গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশ দশকের গ্রামীণ বরিশালের টুকরো টুকরো ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল একবিংশ শতাব্দীর ঋতমের মনে। তাই তো গুগল স্ট্রিট ভিউ দেখে খুঁজে বের করেছিলেন বরিশালের কালীবাড়ি রোডে তাঁদের পৈতৃক ভিটার অবস্থান।
‘আমি একটু ঘুমাব’
২০২৩ সালের ৮ মে, বাংলা ২৫ বৈশাখ। কলকাতার টালিগঞ্জে নিজেদের বাড়িতে ঘুমের মধ্যে মারা গেলেন ঋতম। ঘুমের মধ্যে পরপর চারবার তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়। হাসপাতালে নিতে নিতে সব শেষ।
২০২২ সালে মহারাষ্ট্রের ডিওয়াই পাতিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নিতে গিয়েছিলেন ঋতম। ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন কয়েক দিনের জন্য। এরপর এল সেই সন্ধ্যা।
‘ওই কালসন্ধ্যার কথা কখনো ভুলব না,’ অনুশীল বলে উঠলেন, ‘সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ছেলে আমাকে বলল, “মা, আমি একটু ঘুমাব।” রাত আটটার দিয়ে ওকে জাগাতে গিয়ে দেখি শরীর কেমন অসাড় হয়ে গেছে। তখনো বুঝিনি, দুটো অ্যাটাক হয়ে গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার সময় আরও দুটো…’
কেন এমন হলো?
ঋতমের চিকিৎসক পিতা বললেন, ‘এ প্রশ্নের জবাব কলকাতার কোনো ডাক্তারই ঠিকভাবে দিতে পারেননি। সবাই বলেছেন, পোস্টকোভিড সিনড্রোম।’
রবীন্দ্রনাথকে আদর্শ মানতেন ঋতম। কী আশ্চর্য! কবির জন্মদিনেই পৃথিবীকে ‘বিদায়’ বললেন তিনি!
ঋতম নেই, ঋতম আছে
‘ঋতম নেই, কিন্তু ঋতম আছে…আমাদের মধ্যে ঋতম না থাকলে কি আমরা স্বজন-পরিজনহীন এ দেশে আসতাম!’ সুরঞ্জন ব্যানার্জির হাতে হাত রেখে অনুশীল ব্যানার্জি ঠোঁটে একটা হাসির রেখা আঁকার চেষ্টা করলেন। তবে আমরা দেখলাম, হাসির ছলে চোখের কোণের জল লুকাচ্ছেন সন্তানহারা মা।
বাংলাদেশে রক্তের সম্পর্কে এখন তাঁদের কেউ নেই। থেকেছেন হোটেলে হোটেলে। ঢাকা ছাড়াও গেছেন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও বরিশাল। এসব জায়গায় ঋতমও কি তাঁদের সঙ্গে ছিলেন না? যে প্রথম আলোয় কবিতা ছাপাতে চেয়েছিলেন, অবশেষে এই যে সেখানেই ছাপা হচ্ছে তাঁর কবিতা, তাঁকে নিয়ে লেখা, এখানেও কি ঋতম নেই?