‘এমবিএটা করছ না কেন?’—এই প্রশ্ন কি আপনিও শুনেছেন

চাকরির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন লোপা। স্বপ্ন নিয়ের আয়োজনে মডেল হয়েছেন তিনি
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

৩২ বছর আগে পড়ালেখায় ইতি টেনেছিলেন রোমানা পারভীন। নব্বইয়ের দশকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেছেন। কর্মজীবনেও এরই মধ্যে কেটে গেছে ২৫ বছর। এখন তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের উপপরিচালক। কিছুদিন আগে তাঁকে কর্মক্ষেত্র থেকে জানানো হয়েছে, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের এমবিএ থাকতে হবে। পঞ্চাশোর্ধ্ব রোমানাকে তাই আবার ফিরতে হচ্ছে পড়াশোনায়। ব্যাপারটি অবশ্য সহজভাবেই গ্রহণ করেছেন তিনি। বলছিলেন, ‘কর্মক্ষেত্র আর আগের মতো নেই। ভালো করেই বুঝতে পারছি যে নতুনত্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে নিজেকেই উদ্যোগ নিতে হবে।’

রোমানা পারভীন একা নন; বিশ্ববিদ্যালয়জীবন পেরিয়ে যাঁরা চাকরিজীবনে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন, তাঁদের অনেকেই আবার ফিরছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘এমবিএটা করছ না কেন’—এমন প্রশ্ন তাই তরুণ চাকরিজীবীদের কাছে খুব পরিচিত। একটা সময় পর্যন্ত শুধু ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর বা এমবিএর ঝোঁকটাই বেশি ছিল। এখন অবশ্য উন্নয়ন অধ্যয়ন, গণস্বাস্থ্য, জনপ্রশাসনের মতো বিষয়গুলোর প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে।

চাকরির পাশাপাশি যাঁরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকের উদ্দেশ্য, কারণ, প্রেরণা কিংবা লক্ষ্য অবশ্য ভিন্ন। কেউ কর্মক্ষেত্রের তাগিদে, কেউবা নিজের তাগিদে ফিরছেন পড়ার টেবিলে। কর্মজীবনে প্রবেশের পর এমবিএ করায় কোনো সমস্যা নেই, জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহযোগী অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘স্নাতকের পর বিরতি নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সেটা যেন খুব বেশি সময়ের জন্য না হয়। কারণ, পড়াশোনা থেকে একবার বেরিয়ে গেলে ফিরে আশা কঠিন।’

বিরতির পর ফেরা

চাকরিতে ঢুকব, না স্নাতকোত্তর করব—স্নাতক শেষে অনেকেই পড়েন এই দোটানায়। কেউ হয়তো পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে বলে দ্রুত কাজে ঢুকে পড়তে চেষ্টা করেন। কেউ ভাবেন, আগে খানিকটা অভিজ্ঞতা হোক, তারপর নাহয় স্নাতকোত্তর করা যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চাকরিতে ঢুকে পড়লে পড়ালেখা আর কাজ—দুটো একসঙ্গে সামাল দেওয়া একটু কঠিন। যদি লম্বা একটা বিরতি পড়ে যায়, তাহলে পড়ালেখায় ফেরা আরও কঠিন। এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারলে অবশ্য আখেরে লাভই হয়।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি নিয়েছিলেন পিয়াস বিশ্বাস। পাশাপাশি ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি মাস্টার্স প্রোগ্রামে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে পড়ার বিষয়ের সামঞ্জস্য না পেয়ে শেষ না করেই একসময় ছেড়ে দেন তিনি। বর্তমানে একটি ব্যাংকে কাজ করছেন এই তরুণ। পাশাপাশি এমবিএ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে। পিয়াস বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে ঢুকে যাওয়ার পর এমবিএ করবেন কি না, সেটা অনেকটাই নির্ভর করে কাজের ধরনের ওপর। তবে করপোরেট কাজ করতে হলে একটা মাস্টার্স বা এমবিএ ডিগ্রি বেশ কাজে লাগে।’

২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছিলেন আশা পল (৩৮)। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি পেয়ে যখন মার্কেটিং বিভাগে এলেন, তখন বুঝলেন, কাজের স্বার্থেই তাঁর একটা এমবিএ ডিগ্রি প্রয়োজন। পড়াশোনা শেষের প্রায় ১০ বছর পর আশা ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে। আশা বলেন, ‘কর্মজীবনের জন্য ভালো হবে ভেবেই এমবিএ করা। তবে স্নাতকের পরপরই না করে একটু দেরি হয়ে গেলে একধরনের মানসিক চাপে পড়তে হয়। মনে হয়, সবাই এগিয়ে যাচ্ছে, শুধু আমিই পিছিয়ে পড়ছি। এখন প্রায় সব করপোরেট প্রতিষ্ঠানই একটি এমবিএ ডিগ্রি চায়। তাই পড়াশোনার বয়স ও অভ্যাস থাকতে থাকতে এমবিএ করে ফেলাই ভালো।’

নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া

শুধু যে কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনেই আজকাল তরুণেরা চাকরির পাশাপাশি স্নাতকোত্তর শুরু করছেন, তা নয়; অনেকে শেখার আগ্রহ নিয়েও ভর্তি হন। আবার স্রেফ ডিগ্রির জন্যই ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু পরে পড়ালেখায় আগ্রহ পেয়ে গেছেন, এমনটাও কেউ কেউ বললেন। কর্মজীবনে প্রবেশের পর আবার পড়ালেখা করতে গিয়ে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। তেমনই একজন—ঋতুপর্ণা বৃষ্টি। আহ্‌ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পড়ার পর কীভাবে প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যায়, তা নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। কাজ করতে গিয়ে টের পান, এই বিষয়ে পড়াশোনা থাকলে কর্মক্ষেত্রে এগোনো তাঁর জন্য সহজ হবে। ঋতুপর্ণা ভর্তি হয়ে যান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের স্নাতকোত্তর কোর্সে। তিনি বলেন, ‘নারীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রথম স্নাতকোত্তরের চিন্তা মাথায় আসে। মনে হলো, যা নিয়ে কাজ করছি সে বিষয়ে জ্ঞান থাকা দরকার। আসলে কাজ করতে গেলে অনেক সময় নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। আবার নতুন করে পড়ালেখা করতে গিয়েও অনেক সময় নিজের আগ্রহের জায়গাটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়।’

শিক্ষক, পেশাজীবীরা বলছেন, স্রেফ হুজুগের বশে চাকরির পাশাপাশি স্নাতকোত্তরে না ঢুকে জেনে-বুঝে শুরু করাটাই ভালো। অধ্যাপক খালেদ মাহমুদ যেমন বলছিলেন, ‘শেখার তো নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। মাস্টার্স বা এমবিএ, যা-ই করেন না কেন, প্রয়োজন বুঝে করলে সেটা সার্থক হবে।’