অফিস শেষে থিয়েটারে ছুটতেন অভিনয়শিল্পী মা, সঙ্গে যেত ছোট্ট আর্য। মহড়ায় ব্যস্ত থাকতেন মা-বাবা। আর আর্য শেষ করতেন গণিত, পদার্থ ও রসায়নের বাড়ির কাজ। নাটকের মহড়ার হইহট্টগোলের ভিড়ে আর্যর অবশ্য পড়ায় সমস্যা হতো না। এভাবে পড়ালেখা আর অভিনয়—দুটোর প্রতি ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন আর্য মেঘদূত। একদিকে মঞ্চে কাজ করেছেন, অন্যদিকে ও লেভেল পরীক্ষাতেও রসায়ন বিষয়ে পেয়েছেন সর্বোচ্চ নম্বর। দুইয়ের যোগফল—শতভাগ বৃত্তিসহ যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিমানে চড়েছেন তিনি।
যাওয়ার আগেই মুঠোফোনে কথা হয় আর্যর সঙ্গে। বলছিলেন, ‘থিয়েটারের গান, ঢোলের তাল, অভিনয়ের অনুশীলনের মধ্যেই দিনের পর দিন পড়াশোনা করেছি। পরদিনের স্কুলের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। অনুশীলন শেষেও আড্ডা দিতে অনেকে আমাদের বাসায় আসতেন। আমিও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতাম। আঙ্কেল-আন্টিদের সঙ্গে কথা বলতাম। এটাই প্রায় প্রতিদিনের রুটিন ছিল।’ নাটকে মনঃসংযোগ, চরিত্র নিয়ে ভাবনা, একই চরিত্র বা সংলাপ ভিন্ন ভিন্নভাবে তুলে ধরার চ্যালেঞ্জ—এই বিষয়গুলো পড়ালেখার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছে বলে মনে করেন তিনি।
রূপবতী নামের একটি নাটকে মা সোনিয়া হাসান ও বাবা আসাদুল ইসলামের সঙ্গে প্রথমবার মঞ্চে ওঠেন আর্য। তখন তাঁর বয়স পাঁচ বা ছয় বছর। পরে নাটকের দল ‘ম্যাড থেটার’-এর অংশ হয়ে যান। ২০১৫ সালে মা-বাবার সঙ্গে আবার মঞ্চ ভাগাভাগির সুযোগ হয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে নদ্দিউ নতিম নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
ও লেভেল পরীক্ষায় রসায়ন বিষয়ে সারা বিশ্বের সর্বোচ্চ নম্বরধারীদের একজন হয়েছেন। গণিতেও তাঁর নম্বর ছিল দেশসেরা। ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের এই প্রাক্তনীকে নিয়ে অনুজেরা গর্ব করতেই পারেন।
অক্সফোর্ডে পড়ার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন রসায়ন। রসায়নের সঙ্গে আর্যর রসায়নটা ঠিক কেমন? হেসে বলেন, ‘ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতেও রসায়ন নিয়ে খুব যে আগ্রহ ছিল, এমন নয়। ঠিকমতো বুঝতাম না। ও লেভেলে উঠে মামুন স্যারকে পাই। তাঁর রসায়নের ক্লাসগুলো করে খুব মজা পেতাম। বলা যায়, তখনই বিষয়টা নতুন করে আবিষ্কার করি।’
এ লেভেলের প্রথম বর্ষের পরীক্ষায়ও এই বিষয়ে ৩০০–তে ৩০০ পেয়েছেন আর্য। অক্সফোর্ডে সুযোগ পাওয়া নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘প্রথম আগ্রহ তৈরি করেছেন বাবা। ছোটবেলায় আমার জন্য নিজ হাতে একটা বই বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর পছন্দের শব্দগুলো ছিল। যেমন “পি ফর পর্তুগাল”, “আর ফর রোনালদো” ইত্যাদি। ইউ দিয়ে ছিল “ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড”, হা হা! গত বছর আবেদন করার সময় মা–বাবার পাশাপাশি স্কুলও সহযোগিতা করেছে। অক্সফোর্ডের ফলাফল বের হওয়ার দিন মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না আমার মনে থাকবে সারা জীবন। ওখানে পড়ার খরচ এত বেশি, বৃত্তি না পেলে হয়তো কখনোই সম্ভব হতো না।’
এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ভারতের স্বনামধন্য ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) আয়োজিত ‘ভারত রঙ্গ মহোৎসব’-এ অ্যান ফ্র্যাঙ্ক নাটকে একক অভিনয় করেন এই তরুণ মুখ। প্রশংসাও কুড়িয়েছেন বেশ। উপমহাদেশের অন্যতম বড় এই থিয়েটার উৎসবের অভিজ্ঞতাও মুগ্ধ করেছে আর্যকে। তিনি বলেন, ‘এনএসডিতে ১৯৩০-৪০ সাল থেকে হয়ে আসা প্রতিটি নাটকের পোস্টার আছে। হেঁটে হেঁটে সেগুলো দেখছিলাম। ভাবছিলাম, কয়েক বছর পর এখানে এলে নিজের নাটকের ছবিটিও দেখতে পাব। আসলে ওখানে পৌঁছাতে পারাটাই আমার জন্য বড় পাওয়া। আমরা এনএসডির মূল ভবন ও আসামের ডিব্রুগড়ে মোট দুটি শো করি। কিছু দর্শকের বইটা পড়া ছিল না। বাংলাও সেভাবে বোঝেন না। তবু নাটক বুঝতে কোনো সমস্যা হয়নি। আমার একক অভিনয় দেখে দর্শকের প্রতিক্রিয়া অনেক ভালো লেগেছে।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আর্য বলেন, ‘মঞ্চনাটক আমার জীবনের বড় একটা অংশ। পড়াশোনার পাশাপাশি সব সময়ই এটা চালিয়ে যেতে চাই। যতটা পারা যায়, অক্সফোর্ডে গিয়েও আমার সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করব। আমার সংস্কৃতি এত সমৃদ্ধ, আমাদের এখানে কত ভালো ভালো মঞ্চনাটক হয়, সেটা সবাইকে জানাতে চাইব।’
ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে চান এই শিক্ষার্থী। বিশেষ করে বাংলাদেশে এর প্রভাব বেশ ভাবায় আর্য মেঘদূতকে।