‘এমন দৃশ্য কলেজে অনেক বছর দেখা যায়নি,’ বলছিলেন দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফিরোজ মিয়া।
‘হেল্প ডেস্ক’ নিয়ে বসেছেন বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা। ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের সাহায্য করছেন তাঁরা। দিচ্ছেন নানা প্রশ্নের উত্তর। ফরম পূরণেও সহায়তা করছেন কেউ কেউ। সেদিকে চোখ রেখেই অধ্যাপক ফিরোজ বললেন, ‘শুনেছি ২০০৫-০৬ পর্যন্তও ক্যাম্পাসে এমন চিত্র দেখা যেত। ছাত্র সংগঠনগুলো হেল্প ডেস্ক নিয়ে এভাবে বসত, নবীনদের সাহায্য করত। এরপর একসময় ছাত্ররাজনীতির নামে নানা নোংরামি আর পেশিশক্তির প্রদর্শন শুরু হলো…’
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। বাংলা বিভাগের শোভন হাসান যেমন বলছিলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ত্রাস ছিল ছাত্রলীগ। শিক্ষকেরাও একরকম জিম্মি ছিলেন। কোনো বিভাগ থেকে অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে ছাত্রলীগের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো ছিল বাধ্যতামূলক। আমন্ত্রণ না পেলে তাঁরা অনুষ্ঠানে হট্টগোল করতেন, আয়োজন ভন্ডুল করে দিতেন।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাফরুহা আফরোজ নামের এক শিক্ষার্থী বললেন, ‘যেকোনো পরীক্ষার হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অবাধ যাতায়াত ছিল। তারা পরীক্ষার হলে নকল সরবরাহ থেকে শুরু করে নানা অপকর্ম করত। শিক্ষকেরা ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারতেন না।’
এখনো নানা সংগঠনে ক্যাম্পাসে সরব। তবে হট্টগোল তেমন নেই। ১১ নভেম্বর আন্তবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হলো। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ। ইনডোর স্পোর্টসে মেতেছেন শিক্ষকেরাও।
আন্তবিভাগ ভলিবল ও আন্তক্রিকেট আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। পরীক্ষাতেও ফিরেছে শৃঙ্খলা।
‘এসএসসি পাসের পর বগুড়ার সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হয়,’ সোজাসাপটা বলে দিলেন সুমাইয়া আকতার। উচ্চমাধ্যমিকের এই শিক্ষার্থীর বক্তব্য, ‘আমাদের এখানে পাঠদানের পদ্ধতিও আলাদা। ক্লাসে নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাই ভালো ফল অর্জনের জন্য সব সময় একরকম প্রতিযোগিতা থাকে।’ সুমাইয়া যে খুব ভুল বলেননি, কয়েক বছরের এইচএসসির ফল দেখলে তা আঁচ করা যায়। এ বছর কলেজ থেকে ১ হাজার ৩৯২ জন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পাস করেছেন ১ হাজার ৩৯১ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ২৭৪ জন। ২০২৩ সালে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৩৪। পাস করেছেন ১ হাজার ৩৩৩ জন। আর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৮ জন।
স্নাতক পর্যায়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুনাম আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর মধ্যে র্যাঙ্কিংয়ে তৃতীয় হয়েছে এই কলেজ।
১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আজিজুল হকের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিদ্যাপীঠ। ১৯৬৮ সালে জাতীয়করণ হয়। গত ৮৬ বছরে কলেজটি নানা রকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। উত্তরের আলো হিসেবে খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানে এখন উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও ২৩টি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ আছে। সব মিলিয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার।
আগামী ডিসেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় বসবে ‘ওয়ার্ল্ড ইনোভেটিভ সায়েন্স প্রজেক্ট’–এর আসর। পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় বিজ্ঞান ও গণিত, পরিবেশবিজ্ঞান এবং জ্বালানি ও প্রকৌশল প্রযুক্তি বিভাগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা তাঁদের উদ্ভাবন উপস্থাপন করবেন।
এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আজিজুল হক কলেজ থেকেও যাচ্ছে চার শিক্ষার্থীর একটি দল। চারজনই উচ্চমাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। তাঁদের এ সফরে পৃষ্ঠপোষকতা করছে বেসরকারি সংস্থা টিএমএসএস, বগুড়া জেলা প্রশাসন ও আজিজুল হক কলেজ প্রশাসন।
ইন্দোনেশিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করে ইন্দোনেশিয়া সায়েন্টিফিক সোসাইটি। ১৩-১৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় এ আয়োজনে দলনেতা কৌশিক তাওহীদের নেতৃত্বে আরও তিনজন অংশ নেবেন, সুমাইতা বিনতে হাবিব, নূর নাসিম ও ইমাম রশিদ।
কৌশিক তাওহীদ বলেন, ‘বিশ্বের বাঘা বাঘা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খুদে উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদেরা এ আয়োজনে অংশগ্রহণের জন্য শুরুতে নিবন্ধন করেন। এরপর গবেষণাপত্র জমা দিতে হয়। কোনো জার্নালে উদ্ভাবন প্রকাশ হয়েছে কি না, তা-ও উল্লেখ করতে হয়। এক হাজারের বেশি উদ্ভাবন থেকে জুরিবোর্ড ৪৬টি প্রকল্প চূড়ান্তভাবে মনোনীত করে ওয়েবসাইটে তালিকা প্রকাশ করেছে। যত দূর জানি, বাংলাদেশ থেকে সিলেট সরকারি কলেজ ও সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আমন্ত্রণ পেয়েছে।’
দলের সদস্য সুমাইতা বিনতে হাবিব জানালেন, ‘কৃষি বার্তা’ নামে একটি উদ্ভাবন নিয়ে তাঁরা জাকার্তায় যাচ্ছেন। সুমাইয়া ব্যাখ্যা করলেন, ‘আমাদের দেশে ফসলের রোগবালাই সম্পর্কে কৃষক ততটা অভিজ্ঞ নন। পোকামাকড়ের আক্রমণ, মাটির সমস্যা তাঁরা অনেক সময় বুঝতে পারেন না। এ সমস্যারই সমাধান দেবে কৃষি বার্তা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ নানা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আমরা সমস্যা চিহ্নিত করব, সমাধানও দেব। কৃষক মুঠোফোনে ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমেও সমস্যার সমাধান পাবেন।’
গতকাল ছিল দর্শন বিভাগের পুনর্মিলনী। এ নিয়ে কলেজ প্রাঙ্গণ কয়েক দিন ধরেই বেশ সরগরম। দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে ছিল শোভাযাত্রা, স্মৃতিচারণা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অ্যাশেজ ব্যান্ডের কনসার্ট। তাই পুনর্মিলনীকে ঘিরে উচ্ছ্বাসভরা সময় কাটিয়েছেন সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
পুরোনো শিক্ষার্থীরা একেকজন একেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে তাঁদের যোগাযোগ আছে। মেসেঞ্জারে, মেসেজে বা হোয়াটসঅ্যাপেও চলছিল বার্তা আদান-প্রদান। ‘আমি আসছি! তুই আসবি না?’
আয়োজনের এই মহাযজ্ঞে যুক্ত আছেন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র কাউছার আহমেদ। বর্তমানে ব্যবসার পাশাপাশি চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন তিনি। ২০২০ সালে স্নাতকোত্তর পেরোনো এই তরুণ জানালেন, পুনর্মিলনী সফল করতে শিক্ষক ও অ্যালামনাইরা একসঙ্গে বসেছেন, আলোচনা করেছেন। নতুন-পুরোনোর একটা সেতুবন্ধ তৈরির মধ্য দিয়েই প্রিয় কলেজ আরও এগিয়ে যাবে, এমনটাই প্রত্যাশা তাঁদের। কলেজের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী দেশের বড় বড় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, কেউ কেউ অবসরেও গেছেন। অ্যালামনাইদের নেটওয়ার্কটা যত বেশি শক্তিশালী হবে, অনুজেরা তো ততই ভরসা পাবেন।
মো. শওকত আলম মীর, অধ্যক্ষ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ
উত্তরাঞ্চলের মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার অন্যতম ভরসাস্থল—সরকারি আজিজুল হক কলেজ। এখন কলেজে ২৩টি বিষয়ে সম্মান ও মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। আরও বেশ কিছু আধুনিক ও যুগোপযোগী বিষয়ে সম্মান কোর্স চালুর চেষ্টা চলছে। বিষয়টি বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগির অনুমোদন মিলবে। এইচএসসির ফলাফলেও জিপিএ-৫ এবং পাসের হারের দিক থেকে আজিজুল হক কলেজ রাজশাহী বোর্ডে সেরার স্থান ধরে রেখেছে। প্রতিবছর এ কলেজের ৩০০-৪০০ শিক্ষার্থী বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। বুয়েট, ঢাবি ও মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষায় কখনো কখনো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অর্জনের সুখবরও এনেছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। বিসিএস পরীক্ষাতেও তারা ভালো করছে।
এই কলেজ থেকে পাস করে অনেকেই শিক্ষা ক্যাডারে নিজ কলেজেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রম যেমন ফুটবল, ভলিবল, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, বিতর্ক, পরিবেশ সচেতনতা কার্যক্রম, বইমেলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজনের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। ‘মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে মানবতার সেবক হও’—এটি আজিজুল হক কলেজের স্লোগান। আমরা বিশ্বাস করি, সৃজনশীল নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিকতার ইতিবাচক উন্নয়ন ঘটিয়ে সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।