‘পাওয়ারম্যান মালয়েশিয়া’য় কানিজ ফাতেমা
‘পাওয়ারম্যান মালয়েশিয়া’য় কানিজ ফাতেমা

সাইক্লিস্ট কানিজ যেভাবে পাওয়ারম্যান হয়ে উঠলেন

দৌড় আর সাইক্লিংয়ের সমন্বিত ম্যারাথনকে বলে ডুয়াথলন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ডুয়াথলন প্রতিযোগিতাগুলোর একটা ‘পাওয়ারম্যান মালয়েশিয়া’। মালয়েশিয়ার পুত্রজায়াতে এটিরই ১৯তম আসর অনুষ্ঠিত হয় ৯ জুন। সেখানে ‘ইন্ডিভিজ্যুয়াল শর্ট’ বিভাগে অংশ নেন বাংলাদেশের মেয়ে কানিজ ফাতেমা। ৩ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে সব কার্যক্রম শেষ করে ২১৮৩ জনের মধ্যে ২১০৫তম, ৩৩১ জন নারীর মধ্যে ৩০৯তম এবং ১৬–৩৯ বয়সী ১৪৯ জনের মধ্যে ১৪২তম হন তিনি। স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডিয়ার ডায়েটের প্রধান সমন্বয়ক কানিজ ফাতেমার পাওয়ারম্যান হওয়ার গল্প শুনেছেন তানভীর রহমান

একদম ছোটবেলা থেকেই আমার খেলার প্রতি দুর্বলতা। অন্যদের বাসায় যখন হিন্দি চ্যানেল, নাটক-সিনেমা চলত, আমাদের বাসায় তখন চলত স্পোর্টস চ্যানেল। সম্ভবত ওখান থেকেই দুর্বলতাটার শুরু। স্কুল-কলেজ দুটোই ছিল ভিকারুননিসা (নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ)। সেখানে স্পোর্টস ইভেন্ট থাকলেও অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। প্রথমত, বাসা থেকে স্কুল ছিল অনেক দূরে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার তাড়া থাকত। আর বাবা-মাও চাইতেন না মেয়ে এগুলো করুক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পর চাকরিজীবনে এসে ঠিক করলাম সাইক্লিং করব। সাইক্লিং আমি পারতাম না। শুরু করার পর দেখলাম, এটা ভালো লাগছে। অন্য রকমের একটা স্বাধীনতা বোধ করছি। নিজের মতো করে চলতে পারছি, কোথাও ধাক্কাধাক্কি করতে হচ্ছে না, কেউ গায়ের সঙ্গে লেগে থাকছে না। আবার শরীরচর্চাও হচ্ছে। কোনো খরচ ছাড়াই কর্মস্থলে যেতে পারছি। সব মিলিয়ে সাইক্লিংটা আমার কাছে খুব উপযুক্ত মনে হলো। এর মধ্যে অনেক মেয়ে আমাকে ধরল, তারাও সাইকেল চালানো শিখতে চায়, তাদের যেন শিখাই। তখন ‘স্কুল অব সাইক্লিং: ফেমিনা’ নামের সাইকেল শেখানোর একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। ২০১৬ সালের ৮ মে থেকে করোনাকাল পর্যন্ত এটি চালু ছিল। এই দীর্ঘ চার বছরে প্রায় দুই হাজার মেয়েকে আমরা সাইক্লিং শিখিয়েছি।

বাংলাদেশের পাঁচ প্রতিযোগীই হয়েছেন পাওয়ারম্যান

কোভিডের সময় আমার নিজেরও সাইক্লিংয়ে ভাটা পড়ে। যে কর্মস্থলে যাওয়া-আসার জন্য সাইকেল ছিল নিত্যসঙ্গী, সেটাই যখন অনলাইনে শিফট হয়ে যায়, তখন সাইকেল চালনায় ভাটা তো পড়বেই। আমি পুরোপুরি ঘরবন্দী হয়ে পড়ি। কিছুদিন পর অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত নিলাম, আবার সাইক্লিং শুরু করতে হবে। বন্ধু জাহিদুল ইসলামকে জানাতেই ও পাওয়ারম্যানে অংশ নিতে বলল। শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। কারণ, একে তো অনেক দিন সাইক্লিং করি না, তার ওপর আবার এ বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। ঢাকাতেই কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেইনি, সেখানে একেবারে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা! সবকিছু মিলিয়ে নার্ভাস ছিলাম। আমার বন্ধুই রেজিস্ট্রেশন করে দিল। হাতে তিন মাসের মতো সময় ছিল। বন্ধুর পরামর্শেই (২০২২ সালে পাওয়ারম্যান ডুয়াথলন এশিয়া চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা) রাকিবুল ইসলাম ভাইয়ের অধীনে কোচিং শুরু করি।

বাংলাদেশের পতাকা হাতে কানিজ

ট্রেনিংয়ের এক সপ্তাহের মাথায় আমার বাঁ হাঁটুতে ইনজুরি ধরা পড়ে। এক সপ্তাহ বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করলাম। দুই-তিন সপ্তাহ ভালো চলার পর আবার শারীরিক জটিলতা। এবার স্ত্রীরোগজনিত (গাইনোকোলজিক্যাল)। ১৭ দিন এ সমস্যার মধ্যে কাটালাম। এর মধ্যে শারীরিক কিছু সমস্যাও যোগ হলো। এ অবস্থায় মানসিকভাবে আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়ি। সত্যি বলতে তিন মাসের মধ্যে মাত্র দেড় মাস চর্চা করার সময় পেয়েছি। এমনকি মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যেদিন রওনা হই, সেদিনও শারীরিক সমস্যা ছিল। ডাক্তারের পরামর্শমতো ওষুধ খেয়েও লাভ হচ্ছিল না। এসব নিয়েই প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। বলে রাখি, এই স্পোর্টসের সবকিছুই অনেক ব্যয়বহুল। যেমন এক জোড়া জুতাই কিনতে হয়েছে ২৫-২৬ হাজার টাকা দিয়ে। এ ছাড়া ঘড়ি, সাইকেলের সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক কিছু থাকে। সব মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সম্পূর্ণ খরচ আমার পকেট থেকে গিয়েছে।

৫ কিলোমিটার দৌড়, ৩০ কিলোমিটার সাইক্লিং শেষে আবার ৫ কিলোমিটার দৌড়

প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী, সকাল ছয়টায় প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যাবে। তার আগে জুতা, জেল, পানীয় নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আসতে হবে। আর সাইকেল আগের দিনই জমা দিয়ে আসতে হয়। আমরা পৌনে পাঁচটায় গেটের সামনে এসে দেখি, কোনো গাড়ি নেই। এভাবে ৩০-৩৫ মিনিট পার হলো। অবশেষে ৫টা ২০ মিনিটে একটা গাড়ি জোগাড় হয়। তা–ও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মূল্যে—১০ রিঙ্গিতের ভাড়া ৫০ রিঙ্গিত। পৌনে ছয়টায় আমরা ভেতরে ঢুকি। কোনোমতে জিনিসপত্র রেখে ছয়টার মধ্যে বের হই। ওইখানের আর্দ্রতা তখন ৯১ শতাংশ। মানে কোনো কিছু না করে এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থাকলেও আপনি ঘামতে থাকবেন।

সাইকেল আগের দিনই জমা দিয়ে আসতে হয়

ডুয়াথলন শুরু হলো। আমি ইন্ডিভিজ্যুয়াল শর্ট অর্থাৎ ৫: ৩০: ৫ ক্যাটাগরিতে অংশ নিই। যেখানে ৫ কিলোমিটার দৌড়, ৩০ কিলোমিটার সাইক্লিং শেষে আবার ৫ কিলোমিটার দৌড়াতে হবে। আর এ সবকিছুই সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হবে। তবেই মিলবে পাওয়ারম্যান খেতাব। তখনো আমার পায়ে ব্যথা, শরীরে সমস্যা, তার মধ্যে আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে দরদর করে ঘামছি। এসব সঙ্গী করেই প্রথম পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ালাম। চারদিকে মানুষ, একটা উৎসব উৎসব ভাব—সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগছিল। প্রায় চার হাজার মানুষ একসঙ্গে দৌড়াচ্ছি। যদিও মেয়ে অনেক কম। আমি যে বিভাগে অংশ নিয়েছি, সেখানে ২১৮৩–এর মধ্যে নারী মাত্র ৩৩১ জন। পাঁচ কিলোমিটার শেষ করে দেখলাম, হাঁপ ধরেনি। শুরু করলাম সাইক্লিং। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। প্রথম ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত কষ্ট হয়নি। তারপর প্রচণ্ড রোদ শুরু হলো, মাথার ওপরেই সূর্য। এবার খানিকটা অসুবিধায় পড়লাম। রাস্তায় বিভিন্ন পয়েন্টে আইসোটনিক ড্রিংক, ঠান্ডা পানি, বরফভর্তি পলিব্যাগ দেওয়া হচ্ছিল। আমরা সাইকেল চালাতে চালাতে ওগুলো নিচ্ছিলাম। বরফ নিয়ে প্রথমে হেলমেটের ওপরে ও বুকে রাখলাম। একটু ভয় হচ্ছিল, আবার ঠান্ডা না বাঁধিয়ে ফেলি। তারপর ঠান্ডা পানির বোতল পেলাম। সেখান থেকে এক ঢোক খেয়ে বাকিটা মাথায় ঢাললাম। সাইক্লিং শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, হাতে ভালো রকমের সময় রয়েছে। শেষ করতে পারব, তখনই বুঝতে পারছিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, তাহলে আস্তে–ধীরেই শেষ করি। ট্রানজিশন পয়েন্টে সময় নিলাম। আস্তে–ধীরে এনার্জি জেল, স্যালাইন পানি খেলাম। এরপর সাইকেল রেখে দৌড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু এবার পা একেবারেই চলছিল না। চাইলেও দৌড়াতে পারছিলাম না। এভাবে দুই কিলোমিটার একটু হাঁটা, একটু জগিং মোডে গেল। রাস্তায় আবার পানি, আইসোটনিক ড্রিংক দেওয়া হলো। একটা ঠান্ডা পানির বোতল গায়ে ঢাললাম। মাথায় নিলাম। দেখলাম, দৌড়াতে পারছি এখন। তারপর এক দৌড়ে বাকিটা পথ শেষ করলাম।

পুত্রজায়ায় প্রতিযোগিতাস্থলে ফাতেমা

পাওয়ারম্যান সম্পন্ন করতে পেরে আনন্দ হলো খুব। মুঠোফোন নিয়ে বাসায় কল করলাম। বাবা-মাকে জানালাম, আমি আসলে একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে মালয়েশিয়া এসেছি। বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে এখানে এসেছি এবং সফলভাবে শেষ করেছি। বাবা-মা খুব খুশি হলেন। আমি আসলে তাঁদের আগে বলিনি, পাওয়ারম্যানের জন্য এখানে এসেছি। তাঁরা জানতেন, মালয়েশিয়া যাচ্ছি ঘুরতে।